অবেলায় তুমি বাংলা উপন্যাস | bangla uponnas part 2

 

বাংলা উপন্যাস | bangla uponnas

অবেলায় তুমি বাংলা উপন্যাস | bangla uponnas


-'কি যোগ্যতা আছে তোর আমার সাথে সারাজীবন থাকার? নিজের দিকে একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখেছিস? তোকে আমি কেন রাস্তার পাগল ও তোর সাথে থাকবে না। সেখানে তুই আমার সাথে সারাজীবন থাকার স্বপ্ন দেখছিস?'
তনুর হাতে কিছুক্ষণ আগে থা'প্পড় খেয়ে আকাশের মন খারাপ হলেও তনুর এখনকার কথা গুলো শুনে আকাশের রক্ত মাথায় উঠে যায়। যার ফলে আকাশ কোনো কিছু না ভেবেই দু'হাত দিয়ে হিংস্র পশুর ন্যায় খপ করে তনুর গলা চেপে ধরে সজোড়ে চেঁচিয়ে বলে উঠে,
--'হ্যাঁ আমার কোনো যোগ্যতা নেই। আমি অযোগ্য একটা মানুষ। আর আমার সাথে রাস্তার কোনো পাগল থাকুক আর না থাকুক, কিন্তু তোকে অবশ্যই থাকতে হবে। এটা আমার ফাইনাল কথা। তোকে যেনো আর কখনো ঐ সোহানের সাথে দেখতে না পাই। কথাটা মনে থাকবে তোর?'
তনু কোনো উত্তর দেয় না আকাশের কথায়। কারণ তনুর গলায় বেশ ব্যথা লাগছে। সেই সঙ্গে প্রচন্ড রাগ ও উঠছে তনুর। তার উপরে তনু আকাশের কথায় কোনোদিন ও সম্মতি জানাবে না। তাই তনু চুপ করে আছে। অপরদিকে আকাশ তনুকে চুপ করে থাকতে দেখে আরো জোরে তনুর গলা চে'পে ধরে। এরপর সেই আগের ন্যায় রাগান্বিত কন্ঠে তনুকে বলে,
--'কি হলো আমার কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন?
তুই আর সেই ছেলের সাথে কখনো দেখা-সাক্ষাৎ করবি না। আর কখনো ঐ ছেলের আশেপাশেও যেনো তোকে দেখতে না পাই। এক কথায় তোর সাথে সোহানের আর কখনো যোগাযোগ হবে না। কথাটা কি তোর মনে থাকবে?'
আকাশ তনুর গলা এতো জোরে চেপে ধরে যার ফলে তনুর মনে হচ্ছে সে এখুনি দম বন্ধ হয়ে মা'রা যাবে। তনুর এবার আরো বেশি ব্যথা লাগছে। তনু নিজেকে বাঁচাতে আকাশের কথায় সম্মতি জানিয়ে বলে,
--'হ্যাঁ...হ্যাঁ মনে থাকবে।'
--'তুই আর কখনো ঐ ছেলের সাথে দেখা করবি নাতো?'
--'না আর কখনো ঐ ছেলের সাথে দেখা করবো না।'
--'কথাটা যেনো মাথায় থাকে। মনে রাখবি তোকে আমার সাথে সারাজীবন কাটাতে হবে। ভুলেও কিন্তু কখনো আমায় ছেড়ে ঐ সোহানের কাছে যাওয়ার চিন্তা মাথায় আনবি না। হ্যাঁ আমার কিছু নেই। আর আমি তোর অফিসের কর্মচারী। আমার কর্তব্য হচ্ছে তোর আদেশ মেনে কাজ করা। আর আমি তোর আদেশ মেনেই কাজ করবো। কিন্তু তোকে আমার এই আদেশটা মানতে হবে। তুই আমি ছাড়া অন্য পুরুষের সাথে চলাফেরা তো দূরের কথা, অন্য পুরুষের দিকে দৃষ্টিপাত ও করবি না। মনে থাকবে তোর আমার এই সকল কথা?'
--'হ্যাঁ...হ্যাঁ আমার মনে থাকবে।'
--'কি মনে থাকবে তোমার মুখ থেকে একবার একটু শুনি।'
--'তুমি ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের দিকে তাকাবো না।'
--'মনে থাকে যেনো। এবার ছেড়ে দিলাম। পরের বার আর এমন করবেন না। আর আমি ক্ষমাপ্রার্থী এতো সময় তুইতোকারি করার জন্য। আসলে আমার কেন জানি হুট করে রাগ উঠে গিয়েছিল। তাই পাগলের মতন আচরণ করেছি এতোটা সময় আপনার সাথে। তবে আগামীতে আর কখনো করবো না।'
আকাশ তনুর গলা ছেড়ে দিয়ে তার থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয়। তবে তনু আকাশের কথার প্রত্যুত্তরে পরবর্তীতে আর কিছু বলে না। আকাশ থেকে ছাড়া পেয়ে সোজা গাড়ি স্টার্ট করে অফিসে চলে আসে। এরপর গাড়ি থেকে নেমে সোজা কেবিনে চলে যায়। অপরিদকে আকাশ গাড়ি থেকে নেমে অফিসে প্রবেশ করে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে। ডেস্ক বসে একটু আগের বিষয়টা নিয়ে ভাবতেই আকাশের মনে হয় সে তনুর সাথে যেটা করেছে সেটা বেশ অন্যায়। তনুর সাথে তার এমন করাটা কখনোই উচিত হয়নি। হ্যাঁ বিয়ে করেছে তনু তাকে। কিন্তু তনু তার সাথে সংসার করার জন্য তাকে বিয়ে করেনি। কিন্তু আকাশ এই বিষয়টা নিয়ে একটু অতিরিক্ত করে ফেলেছে তনুর সাথে। অবশ্য একটু নয় অনেক বেশি অতিরিক্ত করেছে সে। আকাশ ভালো করেই জানে সে তনুর সাথে যেটা করেছে সেটার তিন ডবল তনু তাকে ফিরিয়ে দিবে। আকাশ একটু আগের বিষয়টা নিয়ে ভাবনায় মশগুল। এমন সময় তনুর ডাক পড়ে কেবিনের ভিতর থেকে। আকাশ ডেস্ক থেকে উঠে তনুর অনুমতি নিয়ে তনুর কেবিনে প্রবেশ করে। তখনি তনু চেয়ার থেকে উঠে এক গাদা ফাইল ধ্রামম করে আকাশের মুখের উপরে ছুঁড়ে দিয়ে বলে,
--'আমার গলা চে'পে ধরেছিলি না? এবার তুই হারে হারে টের পাবি। আমি তখন নিরুপায় ছিলাম। যার কারণে তুই আমার সাথে ঐরকম টা করে বেঁচে যেতে পেরেছিস। তবে এখন আর পারবি না। এবার তোর কি হাল করবো তুই নিজেও বুঝে উঠতে পারবি না। আর যেই ফাইল গুলো তোকে ছুঁড়ে মে'রেছি, সেসব তুই কালকের ভিতর যে কোনো মূল্যে কমপ্লিট করে দিবি। না হয়তো আগামী তিন মাস তুই কোনো বেতন পাবি না। আমার গলা চেপে ধরার ফল তুই এবার পাবি। তোর খাওয়া-দাওয়া এবং ঘুম আমি সব কিছুই হারাম করে দিব। আগামী কালকের মধ্যে কি ভাবে ফাইল গুলো কমপ্লিট করবি আমি জানি না! তবে সাতটা ফাইল আমার আগামীকাল কমপ্লিট চাই। না হয় যেটা বলেছি তোর সাথে সেটাই হবে। যা এবার ফাইল গুলো মাটিতে থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে কাজে লেগে পড়। আর আমিও নিজের কাজ করি। অবশ্য এখন আমার কোনো কাজ নেই। কারণ আমার কাজ গুলো তোকে করতে দিয়ে দিয়েছি। যা এবার জলদি ফাইল গুলো উঠিয়ে নিয়ে আমার কেবিন থেকে বের হ।'
আকাশ তনুর দিকে এক নজর তাকিয়ে তনুর কথা মতন চুপচাপ ফাইল গুলো মাটি থেকে উঠিয়ে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজের ডেস্কে এসে বসে। এতো গুলা ফাইল দেখে আকাশের মাথা ঘুরতে শুরু করে। তবে তার কিছুই করার নেই। সব কয়টা ফাইল তার যে কোনো মূল্যে আগামীকালের ভিতর কমপ্লিট করতে হবে। না হয়তো আগামী তিন মাস তাকে না খেয়ে ম'রতে হবে। আজ এক বছর ধরে আকাশ সংগ্রাম করে বেঁচে আছে। জীবনটা তার ভালোই চলছিল। কিন্তু হুট করেই বছর খানিক আগে আকাশের বাবা ভয়ানক একটা রোগে আক্রান্ত হয়। যার কারণে আকাশের বাবার চিকিৎসার জন্য সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে হয় আকাশদের। আকাশ ও তার পরিবার বহু চেষ্টা করে আকাশের বাবাকে বাচাঁনোর। দেশের বাহিরেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চিকিৎসার জন্য আকাশের বাবাকে। কিন্তু আকাশের বাবার শেষ রক্ষাটা আর হয়নি। উপর ওয়ালার ডাকে তিনাকে সাড়া দিতে হয়েছেন৷ সেই থেকেই আকাশের পরিবার একদম পথে চলে এসেছে। তাই আজ আকাশকে এতোটা সংগ্রাম করতে হচ্ছে। আকাশ ডেস্কে বসে তনুর দেওয়া ফাইল গুলো রেডি করতে শুরু করে। প্রথম ফাইলটা রেডি করতে করতে দুই ঘন্টা সময় চলে যায়। আর আধঘন্টা বাকি আছে অফিস ছুটি হওয়ার। তবে আকাশের সেই দিকে কোনো খেয়াল নেই। আকাশ একটা ফাইল শেষ করে আরেকটা ফাইলে হাত দেয়। যেই ফাইলটা নিয়ে তনু কিছুটা কাজ করেছিল। আকাশ তনুর কাজ করা ফাইলে হাত দেওয়ার পর দেখে তনুর কাজে কিছুটা ভুল আছে। তাই আকাশ ফাইলটা নিয়ে তনুর কেবিনে যায়। তনু কেবিনে বসে বসে ফোনে কথা বলছিল। আকাশ তনুর কথা বলার ভঙ্গিমা দেখেই বুঝে ফেলে তনু কার সাথে ফোনে কথা বলছে। অপরদিকে তনু আকাশের আগমনে ফোনটা রেখে দিয়ে আকাশকে জিজ্ঞাস করে,
--'কিরে কি হয়েছে?'
--'ম্যাম আপনি হয়তো আমাকে দেওয়া সাতটা ফাইল থেকে একটা ফাইলে নিজে কিছুটা কাজ করেছেন?'
--'হ্যাঁ করেছি। কিন্তু কি হয়েছে এখন?'
--'ম্যাম আপনার কাজে কিছুটা ভুল চোখে পড়েছে। তাই কি করবো জিজ্ঞাস করতে এসেছি।'
--'কি করবি আবার সেসব ঠিক করবি। আর এই ছোট খাটো বিষয় নিয়ে আমার কাছে আসার কি আছে? অযথা আমাকে ডিস্টার্ব না করলে কি তোর পেটের ভাত হজম হয় না? দেখছিস না আমি ফোনে ব্যস্ত আছি। তাও তুই কোন কারণে আমার কেবিনে এসেছিস?'
--'আসলে ম্যাডাম আমি চাইলে নিজের মতন করে ভুল গুলো সংশোধন করতে পারতাম, কিন্তু তাও আপনাকে জিজ্ঞাস করাটা আমার অনেক জরুরী ছিল। না হয়তো নিজের মতন কাবিলতি করতে গেলে দেখা যাবে পরবর্তীতে আপনার থেকে আমাকে আবার কথা শুনতে হবে। তাই জিজ্ঞাস করতে এসেছি।'
--'হয়েছে যা এবার কেবিন থেকে ভাগ। আর আমাকে ডিস্টার্ব করবি না। আমি ফোনে জরুরী কথা বলছি। এমনিতেই তুই আমার অনেক বড় সর্বনাষ করেছিস। আমি বহু কষ্টে সোহানের সাথে সব কিছু ঠিক করেছি। কিন্তু তুই এখন আবার এসে ঝামেলা করছিস। দ্যাখ নিজের বিপদ ডেকে আনিস না। তোকে যেই কাজ দিয়েছি তুই গিয়ে সেটা কর। আর আমাকে আমার কাজ করতে দে।'
--'ঠিক আছে ম্যাডাম আমি গিয়ে নিজের কাজ করছি। কিন্তু ম্যাডাম একটা কথা। আমি না আপনাকে ঐ রাস্তার টোকাইটার সাথে কথা বলতে বারণ করেছিলাম। কিন্তু তাও আপনি ঐ টোকাইটার সাথে ফোনে কথা বলছেন যে?'
আকাশের কথা শুনে তনুর মাথা একশতে একশ গরম হয়ে যায়। বসা থেকে উঠে এসে সোজা আকাশের গালে কোষে কয়েকটা থা'প্পড় লাগিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠে,
--'এই ফকিন্নি তুই কাকে রাস্তার টোকাই বলিস? তোর সাহস তো দেখছি কম না। তুই আমার বয়ফ্রেন্ডকে টোকাই বলিস। তার উপরে আবার আমাকে হুকুম করিস সোহানের সাথে কথা না বলতে। কতো বড় আস্পর্ধা তোর। তখন কিছু বলিনি দেখে সাহস বেড়ে গেছে মনে হয়? একদম থা'পড়ে গালের সমস্ত দাঁত ফেলে দিব আর একবার আমার বিষয় নিতে মাতব্বরি করলে। করুণা করে তোকে চাকরিটা দিয়েছি। কিন্তু তুই তো দেখছি আমার উপরেই অধিকার ফালতে বসে আছিস। তার উপরে আবার সোহানকে নিয়ে যা তা বলছিস। দ্যাখ এটাই তোর জন্য লাস্ট ওয়ার্নিং। এরপর আর একটা মাতব্বরি করলে তোর ঠিকানা হবে জেল খানার ভিতরে। থানায় গিয়ে সোজা তোর উপরে উল্টো-পাল্টা মামলা ঠুকে দিব। তখন কিন্তু হাতে-পায়ে ধরলেও কোনো কাজ হবে না বলে দিলাম। তাই এখনো সুযোগ আছে ভালো হয়ে যা ।আর আমার বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো বন্ধ কর।'
আকাশ আর কোনো কথাবার্তা না বলে তনুর কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজের ডেস্কে এসে বসে। এমন সময় অফিস ছুটি হয়ে যায়। আকাশ চোখ-মুখ কালো করে তনুর দেওয়া ফাইল গুলো হাতে নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে যায়। রিক্সায় করে বাড়ি যাচ্ছে আকাশ। রিক্সায় বসে বসে একটু আগের কথা গুলো ভাবতে থাকে সে। তনু কতো সহজেই তার উপরে হাত তুললো। একটা সময় এই মেয়েই পাগলের মতন তাকে ভালোবাসতো। আর আজ সেই মেয়েই সামান্য একটা কথায় তাকে থা'প্পড় মে'রে লজ্জিত করলো। রিক্সায় বসে বসে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে ভাবতে আকাশের চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। দু'হাত দিয়ে চোখের পানি গুলো মুছে নিয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে আর কখনো সে তনুর বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবে না। আর কখনো সে তনুর জন্য মনের ভিতরে ফিলিংস তৈরী হতে দিবে না। সে এখন থেকে অফিসের কাজ নিয়েই মতলব রাখবে। কারণ তনু কখনোই তার হবে না। এছাড়া সে এখন অন্যের প্রতি আসক্ত। তার উপরে আবার আকাশের এখন কিছুই নেই। কিন্তু তনুর অনেক কিছুই আছে। নাম-ডাক এবং টাকা পয়সার কোনো কমতি নেই তনুর। তাই তনুকে নিয়ে আকাশচুম্বী স্বপ্ন না দেখাটাই আকাশের জন্য শ্রেয়। চুপ করে আকাশ এতোটা সময় রিক্সায় বসে বিষয় গুলা নিয়ে ভাবছিল। কিন্তু ভাবনার এক পর্যায়ে রিক্সা ওয়ালা মামা আকাশকে ডেকে বলে,
--'মামা চইলা আইছি গন্তব্যে।'
আকাশ ভাবনার ইতি টেনে রিক্সা ওয়ালা মামাকে ভাড়া চুকিয়ে বাসায় চলে আসে৷ শরীর পর্যন্ত টায়ার্ড লাগছে। কাঁধের ব্যাগটা খাটের উপরে রেখে ফ্রেশ হতে চলে যায় আকাশ। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম বেরিয়ে আসে। এরপর তনুর দেওয়া ফাইল গুলো কমপ্লিট করতে খাটের উপরেই বসে পড়ে। কাজ করতে করতে রাত একটা বেজে গেছে। আকাশ কিছুক্ষণের জন্য কাজ থামিয়ে ডাইনিং রুমে গিয়ে খাওয়ায় পরিকল্পনা করে। কিন্তু তখনি আকাশের মনে পড়ে তার মা সেই দশটা বাজে তার টেবিলের উপরে খাবার রেখে গেছে। আকাশ তাড়াতাড়ি করে হাত ধুয়ে টেবিলে উপরে থেকে খাবার নিয়ে খেতে আরম্ভ করে। কিন্তু খাবারের প্রথম লোকমা মুখে দিতেই আকাশ দেখে ভাত-তরকারি সব ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। আকাশ সব সময় গরম খাবার খেতে পছন্দ করে। কিন্তু তার এখন কিছুই করার নেই। অপারগ হয়ে ঠান্ডা খাবার গুলোই আকাশ খেয়ে নেয়। খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে আবারো কাজে লেগে পড়ে। সারারাত কাজ করতে করতে কেটে যায়। পুরো রাতে এক ফোটাও ঘুমায়নি আকাশ। রাত জেগে ফাইল গুলো নিয়ে কাজ করেছে সে। তনু সত্যি সত্যিই আকাশের খাওয়া-দাওয়া এবং ঘুম সব কিছুই হারাম করে দিয়েছে আজ রাতে। সকাল আট টার দিকে সাতটা ফাইল পুরোপুরি কমপ্লিট হয় আকাশের। কাজ শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে নয়টার কিছু সময় পর ঘর থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে আকাশ। অফিসে পৌঁছে তনুর কেবিনে সব কয়টা ফাইল রেখে এসে ডেস্কে বসে ঝিমাতে শুরু করে। ঝিমাতে ঝিমাতে এক পর্যায়ে আকাশ ডেস্কের উপরেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায়। আসলে সারারাত জেগে কাজ করায় প্রচন্ড টায়ার্ড আকাশ৷ তাই সে ডেস্কের উপরেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে৷ কিছুক্ষণ পর কেউ একজন জগ ভরে পানি এনে আকাশের মুখের উপরে ছুঁড়ে মা'রায় আকাশ লাফিয়ে উঠে ঘুম থেকে পড়ে। তখনি অপরপাশ থেকে ম্যানেজার আকাশকে বলে উঠে,
--'এখানে কি ঘুমানোর জন্য এসেছেন নাকি মিস্টার আকাশক মাহমুদ?'
আকাশ ম্যানেজারের কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে হ্যাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই সময় ঘটনাস্থলে এসে তনু উপস্থিত হয়। ম্যানেজার তনুকে আকাশের ঘুমিয়ে যাওয়ার বিষয়টা জানায়। তনু ম্যানেজারের কাছে আকাশের ঘুমিয়ে যাওয়ার বিষটা শুনে ম্যানেজারকে বলে,
--'খালেক সাবেব এবার তো ঠান্ডা পানি ছুঁড়ে মে'রেছেন। আগামী থেকে অফিসে এসে ঘুমালে ফুটন্ত গরম পানি ছুঁড়ে মা'রবেন। যাতে করে চেহারার নকশা সহ বদলে যায়। যত্তসব আজাইরা লোক এসে জুটেছে আমার অফিসে।'
তনু আকাশকে অপমান করে নিজের কেবিনে চলে যায়। আর ম্যানেজার ও নিজের কাজে চলে যায়। আর আকাশ ডেস্কের উপরে চুপচাপ বসে পড়ে। তনুর কথায় আর ম্যানেজারের আচরণে মনের ভিতরে কষ্ট লাগলেও উপরে কোনো রিয়াকশন করে না আকাশ। কারণ এসব কিছু তার সাথে নিত্যদিন ঘটতে থাকবে যেটা তার সহ্য করতে হবে। এক ঘন্টা কেটে যায়। ঘড়ির কাটা সবে কেবল এগোরাটা অতিক্রম করেছে। এমন সময় হুট করে তনু রেগেমেগে কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে আকাশের কলার চেপে ধরে আকাশকে জোরপূর্বক টেনে অফিসের সকল কর্মচারীর সামনে নিয়ে যায়। এরপর সবাইকে ডেকে বলে,
--'এই যে দেখুন অফিসের সব চাইতে বড় অকর্মা৷ সে নাকি বলে আরো গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। আমি তাকে কয়েকটা ফাইল দিয়েছিলাম কাজ করার জন্য, কিন্তু সে একটা ফাইলের মধ্যে বিরাট বড় একটা ভুল করে বসেছে। এখন একে কি করা উচিত সবাই বলেন?'
তনুর কথার প্রত্যুত্তরে অফিসের কর্মচারীরা বলে আকাশকে অফিস থেকে বের করে দিতে। কারণ ওর মতন কর্মচারীর জন্য অফিসের অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে। তনু অফিসের কর্মচারীদের কথা শুনে আকাশকে বলে,
--'সবাই ঠিক কথাই বলছে। তুই অফিস থেকে বেরিয়ে যা। কারণ তোর কোনো যোগ্যতা নেই আমার অফিসে কাজ করার। তোর মতন মানুষ আমার অফিসে থাকলে আমার অফিস ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই এখুনি সোজা আমার অফিস থেকে বেরিয়ে যা। না হয় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তোকে বের করে দেওয়া হবে।'
আকাশ তনুর দিকে হতাভাগার মতন তাকিয়ে আছে। কারণ সারারাত জেগে কাজ করার ফল তনু তাকে এভাবে দিবে সেটা সে কখনো কল্পনা করেনি। এক দৃষ্টিতে তনুর দিকে তাকিয়ে আছে আকাশ। অপরদিকে তনু আকাশকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সিকিউরিটিকে ডেকে বকে,
--'সিকিউরিটি এই অকর্মা টাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে অফিস থেকে বের করে দিন। সে কতো বড় বেহায়া হলে এখনো না গিয়ে আমার দিকে বেহায়ার মতন তাকিয়ে থাকতে পারে। বের করে দিন ওকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে।'
তনুর কথা মতন সিকিউরিটি আকাশকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে অফিস থেকে বের করে দিয়ে আসে। সিকিউরিটি আকাশকে অফিস থেকে বের করে দেওয়ার সময় তনু দূর থেকে লক্ষ্য করে তার মা অফিসের প্রধান গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তনুর মা কোনো একটা কারণে অফিসে এসেছিল। কিন্তু তিনি এসে তনুর কৃত্তিকলাপ
সব কিছু দেখে ফেলে। তনু তার মা'কে দেখে মাথা নিচে নামিয়ে ফেলে। অন্যদিকে আকাশকে অফিস থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার পর আকাশ ও মাথা নুইয়ে গন্তব্যহীন ভাবে হাঁটতে আরম্ভ করে....
তনুর কথা মতন সিকিউরিটি আকাশকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে অফিস থেকে বের করে দিয়ে আসে। কিন্তু সিকিউরিটি আকাশকে অফিস থেকে বের করে দেওয়ার সময় তনু দূর থেকে লক্ষ্য করে তার মা অফিসের প্রধান গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তনুর মা কোনো একটা কারণে অফিসে এসেছিল। কিন্তু তিনি এসে তনুর কৃত্তিকলাপ সব কিছু দেখে ফেলে। তনু তার মা'কে দেখে মাথা নিচে নামিয়ে ফেলে। অন্যদিকে আকাশকে অফিস থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার পর আকাশ ও মাথা নুইয়ে গন্তব্যহীন ভাবে হাঁটতে আরম্ভ করে। চোখ থেকে পানি টলমল করে পানি পড়ছে আকাশের। সব কিছুই শেষ তার। না আছে চাকুরী। আর না আছে ইজ্জত। দুটোই তনু তার থেকে কেঁড়ে নিয়েছে। তবে তনু আকাশকে অপমান করে বের করে দিলেও আকাশের জন্য একদিকে সেটা ভালো হয়েছে। কারণ আজ থেকে তাকে আর তনুর কথা শুনতে হবে না। আজ থেকে তনু আর তাকে অপমান করতে পারবে না। চাকুরী করতে এসে তিন বছরের জন্য তনুর কাছে আটকা পড়ে গিয়েছিল আকাশ। সে কখনো চাইলেও নিজ ইচ্ছায় এই চাকুরী ছাড়তে পারতো না। কিন্তু তনু আজ নিজেই তাকে মুক্ত করে দিয়েছে। তবে পরিবারের কথা ভেবে প্রচন্ড হতাশ লাগছে আকাশের। সংসার কি করে সামলাবে সেই চিন্তায় হতাশা এসে ভর করেছে আকাশের উপরে। হতাশাগ্রস্ত হয়ে হাঁটতে হাঁটতে কোনো এক পার্কে গিয়ে বেঞ্চের উপরে বসে চোখের পানি মুছে ভাবতে থাকে কি ভাবে কি করবে সে।
'অন্যদিকে তনুর মা তনুর কৃত্তিকলাপ দেখে পুরোপুরি আশ্চর্য হয়ে যায়। মেয়ের কার্যকালাপ দেখে তিনি কোনো ভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না এটা তারই মেয়ে। ছোট ছোট কদমে হেঁটে অফিসের প্রধান গেইট দিয়ে প্রবেশ করে তনুর কাছে যায় তনুর মা। তনু এখনো মাথা নুইয়ে রেখেছে। তনুর মা তনুর কাছে গিয়ে তনুকে আগাগোড়া ভালো করে দেখতে থাকে আসলেই কি এটা তার মেয়ে তনু কিনা। কারণ একটু আগের কৃত্তিকলাপ দেখে তনুর মা বেশ অবাক। তনুর মা'য়ের যেনো নিজের মেয়েকেই চিনতে কষ্ট হচ্ছে।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তনু তার মা'য়ের তাকানোর ভঙ্গিমা দেখে বুঝতে পারে সব কিছুই তার মা দেখে নিয়েছে। তনু দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যায় এখন সে কি করবে। একটু আগে আকাশকে অফিসের সকল কর্মচারীর সামনে অপমান করে বের করে দিয়ে পৈচাশিক আনন্দ পেয়ে সে। কিন্তু এখন হয়তো তার সমস্ত আনন্দ মাটি হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে সে অপমান ও হতে পারে। কারণ তনুর মা যদি কোনো ভাবে সকলের সামনে তনুকে একটু আগের বিষয় নিয়ে জিজ্ঞাস করে বা তনুর সাথে সেই বিষয় নিয়ে রাগারাগি করে, তাহলে তনুকে লজ্জার মুখে পড়তে হবে। পরিস্থিতি হাতে অনুকূলে চলে যাচ্ছে।
সেজন্য তনু পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য নিজের মা'কে বলে,
--'মা তুমি হটাৎ আজ আমার কি মনে করে?'
--'আসলে একটা কাজের জন্য বেরিয়েছিলাম। কিন্তু কাজ শেষ করে ফেরার পথে ভাবলাম তোর অফিস থেকে একবার ঘুরে যাই। তাই তোর অফিসে এসেছি। কিন্তু অফিসে আসার পর যা দেখলাম তাতে করে আমার তো আস্থা উঠে গেছে তোর উপর থেকে।'
--'মা এই বিষয়টা নিয়ে তোমার সাথে আমি আলাদা জায়গায় কথা বলছি। কিন্তু তুমি প্লিজ এখানে কথাটা উঠিও না। না হয়তো আমার মানসম্মান থাকবে না।'
--'তনু তোর মতন আমাকে ভাবিস না। আর তুই একটু আগে আকাশকে সকলের সামনে অপমান করে তার প্রেস্টিজ ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিস। কিন্তু তাই বলে যে আমি তোকে সকলের সামনে প্রশ্ন করে লজ্জায় ফেলবো বা মানসম্মান নষ্ট করবো এমনটা কিন্তু নয়। কারণ তোর মধ্যে বিবেকবুদ্ধি না থাকলেও আমার মধ্যে আছে। আমি তোর কেবিনের ভিতরে যাচ্ছি। আর তুই ও কেবিনের ভিতরে আয়।'
তনুর মা তনুর কেবিনে যায়। তনুও তার মা'য়ের পিছন পিছন কেবিনে প্রবেশ করে। মা-মেয়ে দু'জনে কেবিনে প্রবেশ করার পর তনুর মা তনুকে প্রশ্ন করে,
--'তনু তুই একটু আগে আকাশের সাথে ঐরকম নোংরা কাজটা কেন করলি? শুধু মাত্র কাজ ভুল করায়?'
--'মা একে তো সে কাজ ভুল করেছে৷ তার উপরে সে গতকাল আমার সাথে জোরজবরদস্তি করেছে। তাই তার উপরে প্রতিশোধ নিয়েছি।'
--'জোরজবরদস্তি মানে?'
--'মা সে গত পরশু আমায় বাসায় খাওয়া-দাওয়া করে আসেনি দেখে তাকে আমি গতকাল রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়েছিলাম খাবার খেতে। তখন আমার সাথে সোহানের দেখা হয়। যাকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু আকাশের কেন জানি সোহানকে সহ্য হয়নি। তাই খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রেস্টুরেন্টে থেকে ফিরে আসবার সময় আকাশ আমার গলা চে'পে ধরে ফোর্স করে বলেছে আজকের পর থেকে সোহানের সাথে না মিশতে। আজকের পর সোহানের সাথে আর কখনো কথা না বলতে। আর আমি চাই আর না চাই আমার বাকিটা জীবন নাকি আকাশের সাথেই কাটাতে হবে৷ তাই আমি তার সাথে আজ এমনটা করেছি। কারণ আমি সোহানকে ভালোবাসি। আমার মনে আকাশকে নিয়ে কিছুই নেই। তাহলে সে আমাকে ফোর্স করে আমার সাথে সারাজীবন থাকার স্বপ্ন দেখে কোন সাহসে? না আমি তাকে ভালোবাসি। না আমার মনে তার জন্য কোনো ফিলিংস আছে। যখন আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম তখন সে পাত্তা দেয়নি। আর আজ সে এসেছে আমার সাথে ভালোবাসার নামে ধান্দা বাজি করতে?'
--'তনু তার মনে ধান্দা বাজি না কি আছে সেটা সে আর উপর ওয়ালা ভালো জানে। তবে সে যেটা করেছে সেটাতে তো কোনো ভুল দেখতে পাচ্ছি না আমি। কারণ তুই নিজেই তাকে তিন বছরের জন্য বিয়ে করেছিস। সম্পর্কে সে তোর স্বামী হয়। তাহলে তার তো অবশ্যই অধিকার আছে তোর উপরে ফোর্স করার। আর সে তোকে তো খারাপ কিছু নিয়ে ফোর্স করেনি৷ শুন তনু সে একটা ছেলে মানুষ৷ আর তুই তার সম্পর্কে অর্ধাঙ্গিনী। তোকে অন্যের সাথে দেখে তার হয়তো গায়ে লেগেছে যার কারণে সে এমনটা করেছে। কিন্তু তার জন্য তো তুই তাকে এভাবে অপমান করে অফিস থেকে বের করে দিতে পারিস না।'
--'মা গত পাঁচ বছর আগে আমি তাকে মনের কথা প্রকাশ করায় সে বড়োজোর শুধু আমার প্রপোজাল প্রত্যাখ্যান করতে পারতো, কিন্তু সে প্রপোজাল প্রত্যাখ্যান করার পাশাপাশি আমায় থা'প্পড় মে'রে অপমান করেছিল। আর মা আমি এই অকর্মা টাকে বিয়ে করেছি তাকে একটা শিক্ষা দেওয়ার জন্য। তার সাথে সংসার করার জন্য নয়। আর সে নিজেও সেটা ভালো করে জানে। কিন্তু তারপরেও সে আমার উপরে অধিকার ফলায় কি করে?'
--'ঠিক আছে মানলাম সে পাঁচ বছর আগে তোকে থা'প্পড় মে'রে অপমান করেছে। আর তুই সেই জন্য তাকে শিক্ষা বা প্রতিশোধ নিতে বিয়ে করেছিস। এছাড়া এটাও মানলাম সে তোর উপরে অধিকার ফলিয়ে ভুল করেছে। কিন্তু তুই যেটা করেছিস বিশ্বাস কর সেটা তোর মোটেও উচিত হয়নি।'
--'মা তোমার কাছে উচিত মনে না হলেও আমার কাছে উচিত মনে হয়েছে।'
--'তনু তোর খুব অহঙ্কার তাইনা এই অফিস-আদালত নিয়ে? একটা কথা জানিস তো তনু অহঙ্কার সৃষ্টিকর্তার গায়ের চাঁদর। তুই কিন্তু সৃষ্টিকর্তার গায়ের চাঁদর নিয়ে টান দিয়েছিস। সৃষ্টিকর্তা কিন্তু তোকে ছাড়বে না। আর তার থেকেও বড় কথা তুই ছেলেটাকে অপমান অপদস্ত করে কাঁদিয়ে অফিস থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিস।
তোর অফিসের সিকিউরিটি যখন তোর কথা মতন ছেলে টাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে, তখন ছেলেটা আমার চোখের সামনে দিয়েই চোখের পানি ফেলতে ফেলতে গিয়েছে। আমি ছেলে টার কান্নার সাথে সাথে ভিতরের আর্তনাদ দেখতে পেয়েছি। তনু আমি তোর মা হয়ে বলছি, বিশ্বাস কর ছেলেটার একটা চোখের পানিও যদি এই অফিসের মধ্যে পড়ে, তাহলে অভিশাপে তোর পুরো অফিস ধ্বংস হয়ে যাবে। এখনো সময় আছে যদি সম্ভব হয় ছেলেটার কাছে ক্ষমা চেয়ে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়।'
--'ঠিক আছে মা মানলাম আমার ভুল হয়েছে। কিন্তু মা তুমি কি জানো শুধু মাত্র ঐ আকাশের কারণে আমার শরীরে পরপুরুষ স্পর্শ করেছে?'
--'আকাশের কারণে তোর শরীরে পরপুরুষ স্পর্শ করেছে মানে?'
--'মানে হলো গত পাঁচ বছর আগে আকাশ আমাকে অপমান করে চলে যাওয়ার বিষয়টা রাস্তার কয়েকজন ছেলে দেখে। যেটা আমি জানি না! আমার বান্ধবীরা আমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে তাড়াও বাড়িতে চলে যায়। এরপর আমি যখন একাকী হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলাম তখন সেই ছেলে গুলো হুট করেই আমার সামনে এসে পথ আঁটকে আমার শরীরে হাত দিতে থাকে। আর সঙ্গে আমাকে বলতে থাকে, একটু আগে দেখলাম একটা ছেলে তোকে থা'প্পড় মে'রে তোর প্রেমের প্রপোজাল রিজেক্ট করেছে। কিন্তু বিশ্বাস কর আমরা তোকে রিজেক্ট করবো না। তুই খালি আমাদেরকে একবার প্রপোজাল দে, তাহলে দেখবি তোকে আমরা সবাই মিলে পরিপূর্ণ তৃপ্তি দিব। মা সেদিন আমি কোনো মতে ছেলে গুলোর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে দৌড়ে পালিয়ে নিজের ইজ্জত বাঁচিয়েছি। না হয়তো সেদিন আমার সর্বনাশ হয়ে যেতো। আর এই জিনিসটা একমাত্র আকাশের কারণে হয়েছে। সে যদি আমাকে গ্রহণ করে নিতো, তাহলে ছেলে গুলো আর ঐ কথা বলে আমার সাথে অসভ্যতা করতে পারতো না।'
--'তনু হ্যাঁ তোর সাথে সেটা খারাপ হয়েছে। তবে এতে আকাশের কোনো দোষ দেখছি না আমি। হ্যাঁ সেদিন আকাশ তোকে রিজেক্ট করেছে। কিন্তু সে নিজে তো তোর সাথে অমনটা করেনি। আর না সে ঐ ছেলে গুলোকে শিখিয়ে দিয়েছে তার বিষয়টা নিয়ে মজা নিতে। আসলে ছেলে গুলোর ভিতরেই শয়তানি ছিল। তাই তারা ওসব কথাবার্তা বলে তোর সাথে নোংরামী করতে চেয়েছে। কিন্তু তুই অযথা ভুল বুঝছিস আকাশকে। তাই তোর কাছে অনুরোধ করবো ছেলে টাকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়। আর আগামীতে কখনো ছেলে টার সাথে অমন করবি না। আর না কখনো ওর মনে কষ্ট দিবি। সে তার মতন অফিসে কাজ করবে। আর তুই তোর মতন কাজ করবি। পার্সোনাল কোনো আক্ষেপ তুই আর তার উপরে কখনো উঠাবি না প্রমিজ কর আমাকে।'
তনু এক বিপাকে পড়ে যায় তার মা'য়ের কথা শুনে। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না তনু। আকাশের উপরে প্রচন্ড ক্ষোভ তনুর। কিন্তু তনুর মা এখন প্রমিজ করিয়ে তনুর হাত-পা বেঁধে দিতে চাইছে। কি করবে কিছুই মাথায় আসছে না তনুর। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তনুকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তনুর মা বলে,
--'ঠিক আছে শুন তোকে আর ফোর্স করবো না। তবে ইচ্ছে হলে আমার কথাটা রাখিস। এবার আমি চললাম।'
তনুর মা চলে যায়। তনুর মা'য়ের নাম সালমা বেগম। সালমা বেগম চলে যাওয়ার পর তনু তার মা'য়ের বলা কথা গুলো নিয়ে ভাবে। কিছুক্ষণ ভাবার পর তনু উপলব্ধি করতে পারে তনু যা করেছে সেটা ঠিক হয়নি। হ্যাঁ আকাশের উপরে তার রাগ অভিমান রয়েছে। কিন্তু তনু এযাত্রায় ও অতিরিক্ত করে ফেলেছে। তনুর ভিতরেও এবার খারাপ লাগছে তখনকার আচরণের কারণে। একটা মানুষ এক দিনের মধ্যে সাতটা ফাইল কমপ্লিট করেছে। তনু তাকে বাহবা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তনু সেটা না করে তাকে উল্টো অপমান করে বের করে দিয়েছে। তনু মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় আকাশের কাছে ক্ষমা চেয়ে তাকে ফিরিয়ে আনবে। ভাবনা-চিন্তা মোতাবেক অফিসের ম্যানেজারের নাম্বার থেকে আকাশের কাছে ফোন দেয়। কারণ তনু ভালো করেই জানে তার নাম্বার দেখলে আকাশ ফোন রিসিভ করবে না। তাই সে ম্যানেজারের নাম্বার দিয়ে আকাশকে ফোন দেয়। কিন্তু আকাশ তাও ফোন রিসিভ করে না। বেশ কয়বার ম্যানেজারের নাম্বার থেকে আকাশকে ফোন দেওয়ার পরেও ফোন রিসিভ করার কোনো নাম-নিশানা নেই আকাশের। তনু বুঝতে পারে আকাশ হয়তো ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছে। না হয়তো ইচ্ছে করেই কারোর ফোন রিসিভ করছে না। তনু আকাশকে ফোনে না পেয়ে ভাবে কি করবে। তখনি তনুর মাথা আসে ফোনের জিপিএস ট্রেকারের সাহায্যে আকাশের খোঁজ পাওয়া যেতে পারে, যদি আকাশ ফোনের লোকেশন অন থাকে। ভাগ্যক্রমে আকাশের ফোনের লোকেশন অন করাই ছিল। অবশ্য আকাশ ফোনের লোকেশন আজীবন এই অন করে রাখে। কারণ রাস্তাঘাটে কখন কি হয় বলা যায় না। তনু আকাশের লোকেশন পেয়ে যায়। অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে লোকেশন দেখে সোজা আকাশের কাছে চলে যায়। আকাশ এখনো পার্কে বসে মন-ম'রা হয়ে কি করবে সেটা নিয়ে ভাবনায় মশগুল। তনু পার্কে গিয়ে আকাশের পাশে বসে। তবে তনু যে আকাশের পাশে গিয়ে বসেছে সেই দিকে আকাশের কোনো খেয়াল নেই। তনু আকাশের পাশে বসে ধীরে ধীরে হাতটা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে আকাশের হাতের উপরে রাখে। যার ফলে আকাশ সাথে সাথে চমকে উঠে। আকাশকে চমকে উঠতে পাশ দেখে তনু আকাশকে বলে,
--'আরে চমকে উঠার কিছু নেই আমি তনু।'
--'হ্যাঁ ম্যাডাম আপনি তনু তা তো দেখতেই পেয়েছি। কিন্তু আপনি এখানে কি করছেন? আর আমার হাত ধরেছেন কেন?'
--'তোর সাথে সময় কাটাতে এসেছি।'
--'মানে?'
--'মানে হলো তুই একা একা বসে আছিস। তাই তোর সাথে সময় কাটাতে চলে এলাম।'
--'ম্যাডাম ফাজলামো করছেন আমার সাথে? আর হাতটা ছাড়ুন।'
--'আরেহ ফাজলামো করছি না। আচ্ছা শুন আকাশ আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখীত তোর কাছে তখনকার আচরণের জন্য।'
--'না ম্যাডাম সমস্যা নেই। আমার কপালে লিখা ছিল ওসব। আর এবার প্লিজ আমার হাতটা ছাড়ুন।'
--'তোর হাত ছাড়ার জন্য তো ধরিনি। তুই এখন আমার সঙ্গে যাবি। তারপর তোর হাত ছেড়ে দিব আমি।'
--'আমি আপনার সঙ্গে যাবো বলতে? কোথায় যাবো আমি?'
--'অফিসে যাবি আবার কোথায় যাবি।'
--'সরি ম্যাডাম আমি আর কাজ করবো না আপনার অফিসে।'
--'আকাশ আমি সত্যিই সরি। আগামীতে আমি আর কখনো তোকে কিছু বলবো না। এবার চল আমার সাথে।'
--'না ম্যাডাম আমি আর কখনো আপনার অফিসে যাবো না।'
--'তোকে যেতে হবে। আমি বললাম তো তোকে আর কখনো কিছু বলবো না।'
--'না ম্যাডাম আমি তাও আর আপনার অফিসে কাজ করবো না।'
--'দ্যাখ আমার রাগ উঠাস না। ভুলে যাস না তুই কিন্তু এখনো আমার কাছে জিম্মি। তাই ভালো ভাবে চল আমার সাথে। তোকে আর আমি কখনো কিছু বলবো না। না হয় কিন্তু জোর করে নিয়ে যাবো বলে দিলাম।'
তনুর কথা শুনে আকাশ নিজের জেদ কমিয়ে ফেলে। কারণ সে ভালো করেই জানে তনুর কাছে সে এখনো জিম্মি। তাই সে তনুর অফিসে ফিরে যাবে বলে মনে মনে ঠিক করে। তবে সে মনে মনে আরেকটা সিদ্ধান্ত নেয়। এবার সে অফিসে যাবে ঠিক, কিন্তু অফিসের পুরো নকশা সে বদলে বদলে ফেলবে। কারণ যেখানে সিস্টেমে সমস্যা সেখানে মানুষকে নয় সিস্টেমকে ঠিক করতে হবে। আজ যেই মানুষ গুলা তাকে অফিস থেকে বের করে দিতে বলেছে, সেই মানুষ গুলাই একটা সময় তাকে ছাড়া কিছু বুঝবে না। এছাড়া তনুকেও সে নিজের আয়ত্তে করে নিবে। কারণ রাজ্যের প্রজাকে নয় রাজাকে পরাজয় করলে পুরো রাজ্য হাতে চলে আসে। আকাশ এখন সেটাই করবে। এতোদিন সে চুপসে ছিল। তবে আর নয়। ধৈর্যের একটা সীমা থাকে। যেটা এবার আকাশের অতিক্রম হয়ে গেছে। কতো ধানে কতো চাল আকাশ এবার এটা তনুকে বুঝিয়ে ছাড়বে....
আকাশ এতোদিন চুপসে ছিল। তবে আর নয়। ধৈর্যের একটা সীমা থাকে। যেটা এবার আকাশের অতিক্রম হয়ে গেছে। কতো ধানে কতো চাল আকাশ এবার এটা তনুকে বুঝিয়ে ছাড়বে। তনুর কথা মেনে নিয়ে আকাশ তনুর সাথে অফিসে যেতে রাজি হয়। তবে যাওয়ার আগে তনুকে বলে,
--'ম্যাডাম আমি আপনার অফিসে যাবো ঠিক, কিন্তু আমি কাজ করতে গিয়ে কোথায় ভুল করেছি সেটা আমাকে দেখতে দিতে হবে। আই মিন ফাইল গুলো আমায় আবার দিতে হবে।'
--'ঠিক আছে দিব। তুই এবার অফিসে চল। অফিসে পৌঁছে তুই নিজেই আমার কেবিনে ঢুকে ডেস্ক থেকে ফাইল গুলো নিয়ে নিস। সব কয়টা আমার ডেস্কের উপরেই রাখা আছে।'
--'ওকেহ।'
আকাশ তনুর সাথে অফিসে চলে যায়। অফিসে পৌঁছে নিজেই গিয়ে তনুর কেবিন থেকে ফাইল গুলো নিয়ে এসে নিজের ডেস্কে বসে দেখতে থাকে কোথায় ভুল হয়েছে। সমস্ত ফাইল ঘেঁটে ঘেঁটে ভুল খুঁজতে থাকে। সাতটা ফাইলের ভিতরে শেষ ফাইলটার মধ্যে আকাশ ছোট খাটো একটা ভুল দেখতে পায়। যেটা কোনো আহামরি ভুল নয়। একবার কলমের গুঁতো দিলেই ভুলটা সংশোধন হয়ে যাবে। এছাড়া আকাশের কাছে আর কোনো ভুল চোখে পড়ে না। আকাশ আশ্চর্য হয় ছোট্ট একটা ভুলের কারণে তনু তার সাথে এমনটা করলো। ফাইল গুলো হাতে উঠিয়ে নিয়ে তনুর কেবিনে চলে যায়। তারপর ফাইল গুলো তনুর ডেস্কের উপরে রেখে বলে,
--'ম্যাডাম একটা সামান্য ভুলের কারণে আপনি আমার সাথে এতো কিছু করলেন? আমার ভুলটা একদম অতি সামান্য ছিল। যেটা চাইলে মিনিটের মধ্যেই ঠিক করা যেতো। কিন্তু আপনি তা না করে আমাকে সকলের সামনে টেনে নিয়ে গিয়ে অপমান করে অফিস থেকেই তাড়িয়ে দিলেন?'
--'আকাশ আসলে তোর উপরে আমার অনেক রাগ উঠেছিল গতকালের কারণে। আমার ইচ্ছে ছিল তোর উপরে প্রতিশোধ নেওয়ার। তাই তোকে সকলের সামনে নিয়ে গিয়ে অপমান করেছি। তবে বিশ্বাস কর তোকে অফিস থেকে বের করে দেওয়ার ইরাদা আমার মধ্যে ছিল না। কিন্তু অফিসের সকল কর্মচারী তোকে বের করে দিতে বলায় আমি কোনো কিছু না ভেবেই তাদের কথা মতন তোকে বের করে দিয়েছি।'
আকাশ তনুর কথা শুনে আবারো আশ্চর্য হয়। একটা মানুষ প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কতোটা নিচে নামতে পারে সেটা তনুকে না দেখলে আকাশ কখনো বুঝতেই পারতো না। এক দিনে সাতটা ফাইল কমপ্লিট করা দু-চারটে কথা নয়। পুরো রাত অর্ঘুমা থেকে ফাইল গুলো কমপ্লিট করেছে আকাশ। তনুর কাছে প্রশংসার পাত্র হওয়ার কথা ছিল আকাশের। সেখানে ক্ষুদ্র একটা ভুলের কারণে উল্টো পুরো অফিসের সামনে লজ্জিত হতে হলো। সেই সঙ্গে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাকে অফিস থেকে বের করে দেওয়া হয়ে হয়েছে। অবাক দৃষ্টিতে তনুর দিকে তাকিয়ে থাকে আকাশ। বলার মতন কিছুই খুঁজে পাচ্ছেনা সে। অপরদিকে তনু আকাশকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে,
--'আমি ক্ষমাপ্রার্থী তোর কাছে। তুই আমাকে ক্ষমা করে দে। আগামীতে আর কখনো তোর সাথে এই রূপ আচরণ করবো না।'
আকাশ কিছু বলে না। মুচকি হাসি দিয়ে তনুর কেবিন থেকে কোনো কথাবার্তা ছাড়া বেরিয়ে যায়। কারণ সম্মান নষ্ট করার জন্য মানুষকে একাধিক বার তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে হয় না। একবার করলেই যথেষ্ট। আর তনু সেটা তার সাথে একবার করে ফেলেছে। আগামীতে করুক আর না করুক তাতে আর তেমন কিছু যায় আসে না। দাগ যা লাগার প্রথম বারেই লেগে গিয়েছে। তাই আকাশ তনুর কথার কোনো গ্রাহ্য না করে কেবিন থেকে বেরিয়ে চলে যায়। আকাশের আচরণে এবার তনুও আশ্চর্য হয়। তনু ভাবে তার কথার প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে আকাশ হুট করেই চলে গেলো। তনুর ভিতরে আকাশের এই ব্যাপার টা কেমন যেনো দাগ কাটে। তবে তনুকে কে বোঝাবে সবে মাত্র শুরু। এখনো বহু দাগ কাটা বাকি। অন্যদিকে আকাশ ডেস্কে বসে বসে ভাবে তনুকে কি ভাবে কন্ট্রোল করা যায়। এমন সময় অফিসের ম্যানেজার আকাশের কাছে এসে বলে,
--'এই আকাশ তোমাকে না ম্যাডাম অফিস থেকে বের করে দিয়েছে? কিন্তু পরবর্তীতে কি মনে করে উনি তোমায় আবার অফিসে নিয়ে আসলো? হটাৎ ম্যাডামের কি হয়েছে? উনি তোমাকে বের করে দেওয়ার পর আমার নাম্বার থেকে বেশ কয়েকবার তোমাকে ফোন দিয়েছে। কাহিনীটা কি?'
ভাবনার অবসান ঘটিয়ে আকাশ ম্যানেজারকে বলে,
--'কাহিনী হচ্ছে অফিসে নাকি গরু,ছাগল দিয়ে ভরপুর। তাই ম্যাডাম আবার আমাকে নিয়ে এসেছে। কারণ গরু,ছাগল দিয়ে কখনোই অফিসের কাজকর্ম হবে না। কাজ কর্মের জন্য কিছু মানুষ দরকার। যেটা ম্যাডাম বুঝতে পাড়ার পর আমাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে।'
--'মানে কি?'
--'এই যে মাত্রই বললাম মানে টা।'
--'আকাশ তুমি কি আমাকে অপমান করলে?'
--'ওমাহ আপনাকে অপমান কেন করবো? ম্যাডামের যা ভাষ্য আমি তো তাই আপনাকে বললাম।'
ম্যানেজার লজ্জা পেয়ে চলে যায়। ম্যানেজার থেকে মুখে পানি ছুঁড়ে মা'রার প্রতিশোধ নিয়েছে আকাশ। ম্যানেজার চলে যাওয়ার পর আকাশ আবারো ভাবতে থাকে তনুর বিষয় নিয়ে। ভাবতে ভাবতে একটা বুদ্ধি আসে আকাশের মাথায়। আকাশ এবার বুদ্ধিটা কাজে খাটাবে। অবশ্য আকাশের এখন তেমন কোনো বুদ্ধি খাটানোর প্রয়োজন নেই৷ কারণ তনু তাকে বলেই দিয়েছে সে আগামীতে আর তাকে কিছু বলবে না। কিন্তু তার পরেও তনুকে রিয়েলাইজ করানো উচিত তনু যেটা করেছে সেটা অনেক বড় অন্যায়। না হয়তো একই ভুল তনু পরবর্তীতে আবার করতে পারে। আকাশ যথারীতি প্রিপারেশন নিয়ে বসে থাকে। দুপুরে লাঞ্চের কিছু সময় আগে তনুর কেবিন থেকে আকাশের ডাক আসে। আকাশ তনুর কেবিনে যায়। তনু আকাশকে নিজের কেবিনে ডেকে নিয়ে ব্যাগ থেকে হাজার টাকার একটা নোট আকাশের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
--'এই নে এক হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে অফিসের বাহিরে যেই কেন্টিনটা আছে সেখান থেকে আমার আর তোর জন্য দুই প্যাকেট খাবার কিনে নিয়ে আয়। আজ দুপুরে আমরা দু'জন এক সাথে লাঞ্চ করবো।'
আকাশ তনুর থেকে টাকাটা নিয়ে চুপচাপ কোনো কথাবার্তা ছাড়া কেবিন থেকে বেরিয়ে কেন্টিনে চলে যায়। কিছু সময় পর কেন্টিন থেকে খাবার নিয়ে ফিরে আসে। তনুর দেওয়া টাকা থেকে খাবার আনার পর অতিরিক্ত অনেক টাকা বেঁচে যায়। আকাশ খাবারের প্যাকেট এবং অতিরিক্ত টাকা গুলো তনুর ডেস্কের উপরে রেখে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসার উদ্দেশ্যে হাঁটা দেয়। তনু আকাশের আচরণে যথারীতি আবারো আশ্চর্য হয়। তবে আগের বারের চাইতে এবার একটু বেশিই আশ্চর্য হয়। কারণ আকাশকে দুই প্যাকেট খাবার আনতে বলেছে তনু। কিন্তু আকাশ এক প্যাকেট খাবার নিয়ে এসেছে। তার উপরে কোনো কিছু না বলেই সে চলে যাচ্ছে। তনু পিছন থেকে আকাশকে ডেকে বলে,
--'এই তুই কোথায় যাচ্ছিস? আর তোকে না বললাম দুই প্যাকেট খাবার আনতে? তাহলে তুই এই প্যাকেট খাবার এনেছিস কি করতে? আমার কথাটা কি তোর কানে যায়নি?'
--'গিয়েছে।'
--'তাহলে দুই প্যাকেট খাবার আনিস নি কেন?'
--'প্রয়োজন মনে করিনি তাই।'
--'মানে?'
--'মানে হলো আপনি অফিসের বস। আর আমি সামান্য একজন কর্মচারী। আপনার সাথে এক সঙ্গে খাবার খাওয়াটা আমার শোভা পায়না। এছাড়া আপনি আমাকে মাসিক বেতন দিবেন কাজের জন্য। যেই টাকা দিয়ে আমার সারা মাস ঘর আর নিজের পকেট চলবে। তাহলে অযথা নিজের টাকা রেখে আপনার টাকায় খেতে যাবো কেন। তাই আর নিজের জন্য খাবার কিনে আনিনি। আচ্ছা ম্যাডাম এবার আমি গেলাম। আপনি খেয়ে নিন।'
আকাশের কথা শুনে তনুর মাথা পুরোপুরি আউলে যায়। তনু পুরো হতভম্ব হয়ে গেছে আকাশের কথা শুনে। তনুর এখন কেমন রিয়াকশন করা উচিত তনু নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। আকাশ তনুর মাথা আউলে দিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে চলে গেছে। তনুর ইচ্ছে করছে পুরো কেবিনের সমস্ত জিনিসপত্র ভেঙ্গে চুর্মাচুর করে ফেলতে। ভয়ানক রকমের রাগ উঠছে তনুর। তবে তনু নিজেকে কোনো ভাবে সামলে নেয়। আর রাগটা ঝাড়ে খাবারের উপরে। আকাশের আনা খাবারের প্যাকেটে তনু কোনো প্রকারের হাত দেয় না। খাবার গুলো ডেস্কের উপরের ফেলে রেখে কাজ করতে থাকে। অন্যদিকে আকাশ তনুকে কৌশলে মা'ইর দিয়ে ডেস্কে এসে বসে আছে। মা'ইরের প্রতিক্রিয়াতে তনুর ভিতরটা জ্বলছে কিন্তু তনু কিছুই বলতে পারছে না আকাশকে। না খেয়েই তনু সারাটা দুপুর কাঁটায়। বিকাল বেলায় অফিস ছুটি হওয়ার মিনিট পাঁচেক আগেই তনু কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে আকাশকে বলে,
--'কাজটা ঠিক করিস নি। অনেক ইচ্ছে ছিল দুপুরে দু'জনে এক সঙ্গে খাবার খাবো। কিন্তু তুই আমার ইচ্ছেটা পূর্ণ হতে দিলি না। তোর উপরে রাগ করে আমারো দুপুরের খাবারটা আর খাওয়া হয়নি।
যাক যা করেছিস ভালো করেছিস। এবার প্রিপারেশন নে বাড়ি যাওয়ার। আর কিছু সময়ের মধ্যেই অফিস ছুটি হবে।'
তনু আকাশকে কয়েকটা কথা বলে অফিস থেকে বেরিয়ে যায়। এদিকে আকাশ তনুর কথা শুনে বুঝতে পারে তার বুদ্ধি কাজে দিচ্ছে। সে যেই হাতিয়ারটা তনুর উপরে প্রয়োগ করেছে, সেটা থেকে সহজে মানুষ বাঁচতে পারে না। তনু যাওয়ার পর আকাশ হাসতে হাসতে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নেয়। এরপর অফিস ছুটি হতেই সে বাড়ি চলে যায়। এভাবেই দিন কাটতে থাকে। আকাশ নিজেকে একদম লিমিটে নিয়ে আসে। তনু আকাশকে কোনো কাজের জন্য ডাকলে আকাশ খুব হিসেব-নিকাশ করে তনুর সাথে কথা বলে। সব সময় মুখ গম্ভীর করে রাখে তনুর সামনে গেলে। এক কথায় আকাশ তনুকে এটা বুঝায় আকাশ তার সাথে কথা বলতে ইন্টারেস্ট না। সেটা হোক কাজের কথা বা এমনিতেই কোনো কথা। আকাশ তনুর সাথে এই জিনিসটা প্রতিদিন করতে থাকে। কিছুদিন যাওয়ার পর তনু লক্ষ্য করে আকাশ কেমন যেনো পাল্টে গেছে। আকাশের ভিতরে কেমন যেনো পরিবর্তন এসেছে। একটা সময় তনুর সাথে সে সাধারণ ভাবেই কথা বলতো। কিন্তু এখন কেমন যেনো এক রকমের হয়ে গেছে। নিশ্চুপ একটা ভাব চলে এসেছে আকাশের মাঝে। ছোট খাটো কোনো কথায় মাথা নাড়িয়ে জওয়াব দেয়। খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু হলে তখন গুনে গুনে এক-দুইটা কথা বলে। সেই প্রথমের আকাশের সাথে এখনকার আকাশকে তনু কোনো ভাবেই মেলাতে পারছে না। আকাশের পরিবর্তনে তনুর ভিতরে কেমন যেনো একটা প্রভাব পড়ে। তবে তনু সেটা আকাশের সামনে প্রকাশ করে না। এভাবেই চলতে থাকে। একদিন অফিস চলাকালীন সময়ে তনু আকাশকে ডেকে বলে,
--'আজ রাতে একটা পার্টি আছে। যেখানে আমার সাথে তোর যেতে হবে। পার্টিটা রেখেছে আসাদ নামক একজন ভদ্রলোক। যিনি কিনা আমার বিজনেস পার্টনার। সেখানে আমার পরিচিত আরো অসংখ্য লোক থাকবে। আর পার্টিতে সোহান ও আসবে। কারণ আসাদ সাহেব আমাকে চেপে ধরেছে পার্টিতে নিজের জীবনসঙ্গী সম্পর্কে সবাইকে জানাতে। এবং বিয়ের ডেট সম্পর্কে এনাউন্সমেন্ট করতে। শুন তুই ভালো জামা-কাপড় পড়ে রেডি হয়ে মাগরিবের পর আমার বাসার নিচে চলে আসিস। তারপর আমরা দু'জন গাড়ি করে যাবো। আর সোহান ও সময় মতন সেখানে পৌঁছে যাবে।'
--'আচ্ছা।'
মাগরিবের পর রেডি হয়ে আকাশ তনুর বাসার নিচে চলে যায়। তনুও রেডি-টেডি হয়ে নিচে এসে আকাশকে নিয়ে গাড়ি করে পার্টিতে এসে হাজির হয়। আকাশ পার্টিতে এসে এক কোণায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আর তনু তার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে এক মেয়ের সাথে কথা বলছে। এমন সময় আসাদ সাহেব তনুর কাছে গিয়ে বলে স্পিকার হাতে নিয়ে স্টেজে গিয়ে সবাইকে নিজের জীবনসঙ্গী সম্পর্কে জানাতে। তনু আসাদ সাহেবকে বলে আর একটু পরেই সে স্টেজে গিয়ে সবাইকে নিজের সম্পর্কে বলবে। এবং সবাইকে নিজের জীবনসঙ্গীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে। আসাদ সাহেব চলে যায়। তনু মেয়েটার সাথে কথা বলা বাদ দিয়ে আকাশের কাছে এসে বলে,
--'আর কতো সময় অপেক্ষা করবো সোহানটার জন্য আল্লাহ জানে! সে এখনো আসছে না। মাথাটা পুরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা তুই কি একটু গেইটের সামনে গিয়ে দেখবি সোহান আসছে কিনা?'
--'আচ্ছা দেখছি।'
আকাশ গেইটের সামনে চলে যায় সোহান আসছে নাকি দেখার জন্য। কিন্তু সোহান আসার কোনো নাম গন্ধ নেই। আকাশ ফিরে এসে তনুকে বলে সোহানকে দেখতে পাওয়া যায়নি। তনু আকাশের কথা শুনে আকাশকে বলে,
--'ওর আসার গুষ্টি মা'রি। ওর আর আসতে হবে না। তুই চল আমার সাথে। তুই একদম চুপচাপ থাকবি। আর আমি ডাকলে পরে তুই আমার কাছে যাবি। আর আমি যেমন যেমন বলবো তুই শুধু সেটার উপরে ভিত্তি করে পরে সবাইকে কিছু বলবি।'
আকাশ কিছুই বলে না। তনু আকাশকে নিয়ে গিয়ে সামনে একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেয়। আর সে স্পিকার হাতে নিয়ে স্টেজে গিয়ে উঠে। এরপর আকাশকে সবাইকে দেখিয়ে দিয়ে বলে,
--'ঐ যে মানুষটা সে হচ্ছে আমার প্রিয় মানুষ। আমরা দু'জন একটা মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে রয়েছি। দু'জনের মধ্যে গভীর প্রেম চলছে। অল্প কয়দিন পরেই আমরা দু'জন বিবাহ করবো।'
তনু আকাশকে নিজের বয়ফ্রেন্ড বলে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আকাশকে স্টেজে ডেকে তার হাতে স্পিকার দিয়ে বলে তাদের দু'জনের সম্পর্কে কিছু বলতে। আকাশ স্টেজে গিয়ে সোজা তনুর মুখে চুনকালি মেখে দিয়ে বলে,
--'আমরা দু'জন কোনো মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে নেই। আমি উনার অফিসের একজন কর্মচারী। আর উনি আমার অফিসের ম্যাডাম। উনার বয়ফ্রেন্ড হচ্ছে সোহান নামক একজন ভদ্রলোক। যিনি এই পার্টিতে আসার কথা ছিল। কিন্তু কোনো কারণে উনি আসতে না পারায় ম্যাডাম আমাকে উনার বয়ফ্রেন্ড বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি চাইনা আপনারা কেউ বিভ্রান্ত হন। তাই উনাকে আরো কিছুটা সময় দিন। কিছু সময়ের মধ্যে হয়তো উনার আসল প্রেমিক সোহান চলে আসবে।'
আকাশ সবার সামনে সত্যিটা বলে স্টেজ থেকে নেমে পার্টি থেকে বেরিয়ে চলে যায়। এদিকে আকাশের কর্মকান্ডে লজ্জায় তনু স্টেজে দাঁড়িয়ে কান্না করে দিয়েছে। সবাই তনুর দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে
আছে। কিছুক্ষণ পর তনুও লজ্জায় স্টেজ থেকে নেমে কান্না করতে করতে পার্টি থেকে বেরিয়ে চলে যায়। পার্টি থেকে বেরিয়ে গাড়িয়ে গিয়ে উঠে বসে। গাড়িতে আগ থেকেই আকাশ বসা ছিল। আকাশ ও পার্টি থেকে বেরিয়ে এসে গাড়ির মধ্যে উঠে বসেছে। তনু গাড়িতে উঠে আকাশকে দেখতে পেয়ে রাগে আকাশের শার্টের কলার টেনে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে চেঁচিয়ে বলে,
--'কেন তুই আমার সাথে এমনটা করলি?'
--'কারণ আপনি মিথ্যা বলেছেন সবাইকে। আমি আপনার কোনো বয়ফ্রেন্ড না। আপনার বয়ফ্রেন্ড হচ্ছে সোহান। কিন্তু আপনি আমাকে সবার সামনে বয়ফ্রেন্ড বলে মিথ্যা পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তাই আমি সবার সামনে ঐরকমটা বলেছি।'
--'আসলেই তুই একটা নিচু মনের মানুষ। ঐরকমটা করার আগে তোর দশ বার ভাবা উচিত ছিল। আর কি বললি আমি মিথ্যা বলেছি? শুন আমি কোনো মিথ্যা বলিনি। আর সোহান আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড না। সে শুধু মাত্র আমার ফ্রেন্ড।'
আকাশ তনুর কথা শুনে ভুত দেখার মতন চোখ বড় বড় করে তনুর দিকে তাকিয়ে থাকে....
চলবে...
আসলেই তুই একটা নিচু মনের মানুষ। ঐরকমটা করার আগে তোর দশ বার ভাবা উচিত ছিল। আর কি বললি আমি মিথ্যা বলেছি? শুন আমি কোনো মিথ্যা বলিনি। আর সোহান আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড না। সে শুধু মাত্র আমার ফ্রেন্ড।'
আকাশ তনুর কথা শুনে ভুত দেখার মতন চোখ বড় বড় করে তনুর দিকে তাকিয়ে থাকে। তনুর মুখে আকাশ এই কথাটা শুনার জন্য কখনোই প্রস্তুত ছিল না। আকাশ পুরো নিশ্চুপ হয়ে যায়। মনে হচ্ছে যেনো আকাশ কোনো টাইম জোনে আঁটকে গেছে। যেখানে সব কিছু এক জায়গায় বিদ্যমান হয়ে আছে। না কোনো কিছু সামনে এগোচ্ছে না পিছনে যাচ্ছে। আকাশ বড়সড় রকমের শকট খায়। কিছুটা সময় বিস্মিত অবস্থায় কেটে যায় আকাশের। কিছুক্ষণ পর আকাশ স্বাভাবিক হয়। আর একে একে আকাশের ভিতরে প্রশ্ন জাগতে শুরু করে। তবে সে এখনো সাইলেন্ট। অপরিদকে তনু আকাশকে চুপ করে থাকতে দেখে সজোড়ে নাড়িয়ে বলে,
--'কিরে কথা বলছিস না কেন এখন? স্টেজে তো আমার মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিস। কিন্তু এখন চুপ করে আছিস কেন? সোহানের কথা শুনে কি আশ্চর্য হয়েছিস নাকি?'
--'জ্বি আশ্চর্য তো হয়েছি। তবে আমি জানি আপনি একটু আগে যেই কথাটা বলেছেন সেটা পুরোটাই মিথ্যা। সোহান আপনার কোনো ফ্রেন্ড নয়। সে আপনার বয়ফ্রেন্ড। আপনি অযথা আমাকে গোমরাহ করার চেষ্টা করিয়েন না।'
--'আকাশ আমার মাথা কিন্তু প্রচন্ড খারাপ হচ্ছে। এবার তোকে কিন্তু গলা টি'পে মে'রে ফেলবো বলে দিলাম। এই অসভ্য আমার কাছে তোর কথা গুলো কি কারণে মিথ্যে বলে মনে হচ্ছে?'
--'কারণ সেই শুরু থেকেই দেখে আসছি আপনাদের কান্ডকারখানা। এবং আপনি নিজেও বলেছেন সোহান আপনার বয়ফ্রেন্ড হয়। কিন্তু আজ এসে বলছেন সে আপনার ফ্রেন্ড। ম্যাডাম আপনি এক মুখে কয় ধরনের কথা বলেন?'
--'আমি এক মুখে হাজার ধরনের কথা বলি। তবে সত্যি এটাই সে আমার ফ্রেন্ড। কোনো বয়ফ্রেন্ড না।'
--'তাহলে আজ এসব কি ছিলো? সোহান পার্টিতে আসলে আপনি ওকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবেন। এবং সেই সঙ্গে নিজেদের বিয়ের ডেট এনাউন্সমেন্ট করবেন। কিন্তু কোনো কারণে সোহান না আসায় এখন কথার মোড় ঘুরলো কেন?'
--'সে আমার বয়ফ্রেন্ড হলে তবেই তো পার্টিতে আসবে। কিন্তু সে তো আমার বয়ফ্রেন্ড না। আর সে এই পার্টি সম্পর্কে কোনো কিছুই জানে না। আর না তাকে আমি কিছু বলেছি। সে যদি সত্যিই আমার বয়ফ্রেন্ড হতো তাহলে সে এতো সময়ে এই পার্টিতে থাকতো। কিন্তু সে আমার ঐরূপ কেউ লাগে না দেখেই আজ পার্টিতে আসেনি।'
--'মানে কি? সে যদি না আসার হয় তাহলে আপনি আমাকে গেইটের সামনে গিয়ে সোহান আসছে কিনা সেটা দেখার জন্য পাঠিয়েছিলেন কেন?'
--'কারণ এটা একটা প্ল্যান ছিল তোকে হতাশ করার।'
আকাশ তনুর কথার আগামাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। কেমন যেনো পেঁচানো লাগছে তনুর কথা গুলো তার কাছে। তাই সে তনুকে বলে,
--'ম্যাডাম আমি আপনার কোনো কথাই বুঝে উঠতে পারছি না। প্রথমে বললেন সোহান আপনার বয়ফ্রেন্ড না। আবার বললেন সোহান পার্টির সম্পর্কে জানেই না। কিন্তু আপনি আমাকে ওর খোঁজে গেইটে পাঠিয়েছেন। আবার পরিশেষে বলছেন তার খোঁজে পাঠানোর কারণ ছিল আমাকে হতাশ করা। ম্যাডাম এই সমস্ত কথা শুরু থেকে আমাকে আবার একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?'
--'ঠিক আছে শুন। এতোদিন সোহান সম্পর্কে যা শুনেছিস সব মিথ্যা। আর যা দেখেছিস সব আমাদের সাজানো নাটক ছিল। আর এসব কিছু করার পিছনে কারণ ছিল তোকে কষ্ট দেওয়া। কারণ তুই আমাকে পাঁচ বছর আগে কষ্ট দিয়েছিস। তাই তোর উপরে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এমনটা করেছি সোহানের সাথে মিলে। তোর উপরে আমার অনেক অভিমান। আমি তোকে বিয়ে করেছি নিজের কাছে রেখে কষ্ট দেওয়ার জন্য। তবে সব কিছুর ভিড়ে আমার মন তোকে এখনো ভালোবাসে। আর আমার সাথে তোর বিয়েটা যেভাবেই হোক না কেন, আমি জানি আমি অন্য পুরুষের সাথে মিশলে তোর খারাপ লাগবে। আমি সেজন্য সোহানের সাথে মিলে এমনটা করেছি। আর আজকে এই পার্টিতে নিজের ব্যক্তিগত সম্পর্কে জানানোটা আমার অনেক প্রয়োজন ছিল। কারণ আসাদ সাহেব আমাকে পছন্দ করেন। কিন্তু উনাকে আমি পছন্দ করি না। তাই উনি আমাকে পছন্দ করেন এই বিষয়টা আমাকে জানানোর পর আমি বলেছিলাম আমি সিরিয়াস একটা রিলেশনে আছি। তাই আমার একজনকে নিজের বয়ফ্রেন্ড বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা আবশ্যক ছিল। আমি চাইলে সোহানকে সবার সামনে বয়ফ্রেন্ড বলে পরিচয় করিয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু কেন জানি অমনটা করতে আমার মন মানছি না। আর তাছাড়া এটা নিয়ে পরবর্তীতে সমস্যাও হতে পারে। কিন্তু তোর বিষয়টা নিয়ে আমার মনে কোনো দ্বিধাবোধ কাজ করছিল না। কারণ তোকে আমি ভালোবাসি। আর তোর সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। তার উপরে তুই আমার হাসবেন্ড। মোট কথা সব কিছু মিলিয়ে মনের মধ্যে একটা আস্থা হচ্ছিল। সেজন্য আজ আমি তোকে এখানে এনে সবার সামনে নিজের বয়ফ্রেন্ড বলে ইন্ট্রোডিউস করিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তুই আমার মানসম্মান এক মুহূর্তের মধ্যেই সব ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিস।'
--'তার মানে এতোদিন যা দেখেছি সব কিছুই সাজানো নাটক ছিল? আর আজকে সোহানের বিষয়টা নিয়ে মিথ্যা বলার কারণ ছিল আমাকে কষ্ট দেওয়া?'
--'হুমম।'
তনুর কথাবার্তা শুনে আকাশ কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। মাথায় কিছু কাজ করছে না আকাশের। সব কিছুই আকাশের কাছে স্বপ্নের মতন লাগছে৷ আকাশ এতোদিন ভেবে বসেছিল তনু তাকে অনেক বেশি ঘৃণা করে। কিন্তু আজ দেখছে সব কিছুর আড়ালে তনু তাকে এখনো ভালোবাসে। আকাশের ভিতরটা খুশীতে ফেটে যাচ্ছে। আকাশ তনুর দিকে মায়াবী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এমন সময় তনুর কাছে সোহানের ফোন আসে। তনু আকাশের কলার ছেড়ে দিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে আকাশকে বলে,
--'দ্যাখ আমার কথা গুলো কতোটা সত্য সেটার আরো প্রমাণ দিচ্ছি তোকে।'
তনু সোহানের ফোন রিসিভ করে লাউডস্পিকারে দেয় সোহানের কথাবার্তা গুলো আকাশকে শুনার জন্য। তনু ফোন রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে সোহান তনুকে বলে,
--'দোস্ত কোথায় রে তুই?'
--'এই তো আছি দোস্ত গাড়িতে। কিন্তু কেন?'
--'আরেহ দোস্ত বাসা থেকে বিয়ের জন্য মেয়ে দেখছে। কিন্তু তুই তো জানিস আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। কারণ বিয়ে করলে খাঁচায় বন্দী হতে হবে। এছাড়া সব কিছু একটা লিমিটে থাকতে হবে। যেটা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি নিজের স্বাধীন মতো আরো কিছুদিন কাটাতে চাই। কিন্তু মা এবার অনেক জোরাজোরি শুরু করেছে। দোস্ত তুই পারলে আমার এই বিষয়ে কোনো একটা সাহায্য কর।'
--'আচ্ছা শুন আমি এখন গাড়িতে আছি। পরে ফ্রি কি ভাবে কি করা যায় সেই বিষয় নিয়ে আলাপ করবো নে তোর সাথে।'
--'আচ্ছা।'
তনু ফোন কেটে দেয়। এরপর আকাশকে বলে,
--'শুনলি তো সব কথা? এবার বিশ্বাস হয়েছে তো সে আমার বয়ফ্রেন্ড না?'
আকাশ কিছু না বলে তনুকে খপ করে নিজের কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে। তনু আকাশের আচরণে কিছুটা চমকে উঠে। সেই সঙ্গে জড়িয়ে ধরার বিষয়টা তনুর ও বেশ ভালো লাগে। কিছু সময় তনু নিজেও আকাশের জড়িয়ে ধরার বিষয়টা উপভোগ করে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর হুট করেই তনু জোরপূর্বক আকাশ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আকাশকে বলে,
--'এখন আদিখ্যেতা দেখিয়ে কোন লাভ নেই। তুই সারাজীবন আমাকে অপমান করেই যাবি। পাঁচ বছর আগে একবার করেছিলি বান্ধবীদের সামনে। আর আজ আবারো করলি আমার বিজনেস পার্টনারদের সামনে। তোর প্রতি আমার আর কোনো ফিলিংস নেই। সব কিছু শেষ করে দিয়েছিস তুই।'
--'তনু তুমি শেষ করলেও এবার আমি শুরু করবো।'
--'কথার লেহাজ ঠিক কর। আমি তোর ম্যাডাম। আমাকে তুমি ডাকার সাহস কি করে হয়?'
--'সাহসের তো এখনো কিছুই দেখো নি। সবে মাত্র শুরু। আগামীতে দেখে থাকো আরো কি কি হয়। আর তুমি আমার ওয়াইফ লাগো সম্পর্কে। তোমাকে আপনি ডাকার কোনো প্রশ্নই আসে না। হ্যাঁ অফিসে তোমাকে তোমার যথারীতি সম্মান আমি দিব। কিন্তু অফিসের বাহিরে তোমাকে আমি তুমি করেই ডাকবো।'
--'আকাশ অতিরিক্ত করিস না। অতিরিক্ত করা কিন্তু ভালো নয়। তোর জন্য মনে যেই টুকু জায়গা ছিল সেসব তুই নিজেই শেষ করে দিয়েছিস। তাই এখন আর ভনিতা করিস না। আর আজ থেকে তোকে নিয়ে আমার মনে আর কোনো ভালোবাসা নেই। আমি আমার জীবনে নতুন কাউকে টেনে নিব। দরকার হয় সোহানের সাথে সম্পর্কে জুড়বো, তবে তোর সাথে আর নয়। আজ থেকে তোর আর আমার পথ আলাদা। এবার তুই গাড়ি থেকে নাম। তোর সঙ্গে একসাথে আমি সফর করবো না।'
আকাশ তনুর কথা মতন চুপ করে গাড়ি থেকে নেমে যায়। তবে নামার আগে সে তনুকে বলে,
--'ঠিক আছে আমিও দেখবো তুমি দু'জনের পথ আলাদা করো কি ভাবে।'
তনু আকাশের কথার প্রত্যুত্তরে আর কিছু না বলে গাড়ি টেনে চলে যায়। আর আকাশ গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার পর রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবে, তনু
যতোই তাকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বিয়ে করুক, আর যতোই তার উপরে প্রতিশোধ নিক, আকাশ ততোই তনুকে আগলে নিব। কারণ শুরুটা গত পাঁচ বছর আগে আকাশ নিজেই করেছে। গত পাঁচ বছর আগে সে তনুর সাথে ঐরকমটা না করলে তনু কখনোই তার সাথে এমনটা করতো না। এছাড়া আজ যেহেতু তনু নিজেই ভালোবাসার কথা বলেছে, তাই আজ থেকে আকাশ তনুকে নিজের করে নেওয়ার সংগ্রামে নামবে। যতো ঝড়ঝাপটা আসবে আসুক, কিন্তু তনুকে সে অন্য কারোর হতে দিবে না। তনুকে যেভাবেই হোক সে নিজের প্রিয়তমা বানিয়ে ছাড়বে। আকাশ রাস্তায় দাঁড়িয়ে তনুকে নিয়ে নতুন পরিকল্পনা সাজায়। এরপর একটা রিক্সা থামিয়ে সেটাতে উঠে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে পড়ে...
আকাশ ঠিক করে যতো ঝড়ঝাপটা আসবে আসুক, কিন্তু তনুকে সে অন্য কারোর হতে দিবে না। যেভাবেই হোক তনুকে সে নিজের প্রিয়তমা বানিয়ে ছাড়বে। আকাশ রাস্তায় দাঁড়িয়ে তনুকে নিয়ে নতুন পরিকল্পনা সাজায়। এরপর একটা রিক্সা ডেকে রিক্সায় উঠে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে পড়ে। কিছু সময় পর আকাশ বাড়ি গিয়ে পৌঁছায়। বাড়ি পৌঁছে দরজার কলিংবেল চাপতেই আকাশের মা রহিমা বেগম দরজা খুলে দেয়। আকাশ বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। রহিমা বেগম ছেলেকে তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলে আসতে দেখে জিজ্ঞাস করে,
--'কিরে আকাশ তুই এই জলদি বাড়ি ফিরে আসলি? তুই না বলেছিলি তনুর সাথে কোথায় যেনো পার্টিতে যাবি। তাহলে এতো জলদি বাড়ি ফিরে আসলি যে? গিয়েছিস তো এক ঘন্টাও হয়নি। পার্টি কি শেষ হয়ে গিয়েছে নাকি?'
--'না মা পার্টি শেষ হয়নি। আমি মাঝ পথেই চলে এসেছি।'
--'ওমাহ কেন!'
--'কারণ মা আমি একটা অঘটন ঘটিয়েছি।'
--'অঘটন ঘটিয়েছিস মানে? কি করেছিস তুই?'
--'মা আমি তনুর ইজ্জতের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছি। সকলের সামনে তনুর কথার বিরোধিতা করেছি।'
--'তনুর কথার বিরোধিতা করেছিস মানে কি আকাশ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!'
--'মা আমি তোমায় খুলে বলছি। তাহলে তুমি বুঝতে পারবে। আসলে মা আজ আমরা যেই পার্টিতে গিয়েছি সেখানে তনু নিজের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আই মিন নিজের পছন্দের মানুষ সম্পর্কে সবাইকে জানানোর কথা ছিল। এবং সেই সঙ্গে তার পছন্দের মানুষটাকে সবার সাথে পরিচিয় করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তাঁদের বিয়ের বিষয় নিয়েও এনাউন্সমেন্ট করার কথা ছিল। কিন্তু তনু হুট করেই আমাকে সবার সামনে নিজের প্রিয় মানুষ বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আর আমি সবার সামনে তনুর বিরোধিতা করে বলেছি আমি তার প্রিয় মানুষ না। যার কারণে তনুর অনেক অসম্মান হয়েছে। আর সে পার্টি থেকে চলে গিয়েছে।'
--'আজব তুই এমনটা কেন করলি? সে তোকে নিজের প্রিয় মানুষ বলে সবার সামনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তোর তো আরো খুশি হওয়ার কথা। সেখানে তুই তাকে সবার সামনে অপমান করালি কেন?'
--'মা আগে বাকি কথা টুকু শুনো। আমি তনুকে সাধে অপমান করিনি। আসলে সেই শুরু থেকেই আমি জানি তনুর একজন বয়ফ্রেন্ড আছে যার নাম সোহান। যাকে দেখলেই আমার গায়ে জ্বালাপোড়া করে। আর আজকের পার্টির মধ্যে সোহানের আসার কথা ছিল। আর তনু আমাকে নয় তাকে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। যেটা শুনে আমার ভিতরটা খালি উথাল-পাতাল করছিল। সেই সঙ্গে চরম রাগ ও উঠছিল। তবে আমি নিজেকে কোনো রকমে সামলে রেখেছিলাম। কিন্তু কাহিনী ঘটে সোহান না আসায়। তনু কি করে সোহান না আসার কারণে হুট করেই আমাকে নিয়ে গিয়ে নিজের বয়ফ্রেন্ড বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। যেটা দেখে আমার আরো প্রচন্ড রাগ উঠে যায়। একে তো তার সাথে সোহানের সম্পর্ক রয়েছে। তার উপরে আজকে সোহানকেই সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সোহান না আসায় আমাকে দিয়ে কাজ চালিয়েছে। তাই আমি রেগে গিয়ে সবাইকে বলে দিয়েছি তনুর বয়ফ্রেন্ড আমি নয় সোহান। যার কারণে তনুর চরম অপমান হতে হয়েছে। কিন্তু মা জানো এই কাজের কারণে পরবর্তীতে আমার নিজেকেই আফসোস করতে হয়েছে। কারণ আমি তখন ও জানতাম না আসল কাহিনী কি। পরবর্তীতে জানতে পারলাম সোহান তনুর বয়ফ্রেন্ড না। তনু সোহানের সাথে মিলে বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ডের নাটক করে আমাকে কষ্ট দিতে চেয়েছে। তবে সত্যিকারত্বে সে আমায় এখনো ভালোবাসে। আর আজকের পার্টিতে সোহান নয় আমাকেই সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছিল সে। মা বিশ্বাস করো তনুর মুখ থেকে সমস্ত সত্যি জানার পর আমি আফসোস করতে করতে শেষ হয়ে যাচ্ছি।'
--'আকাশ তুই কাজটা একদম ঠিক করিস নি। মেয়েটা না হয় তোর উপরে অভিমান করে তোর থেকে প্রতিশোধ নিয়েছে। কিন্তু তুই তো তাকে ভরা মজলিসের সামনে লজ্জিত করেছিস। যেটা সত্যিই তোর উচিত হয়নি।'
--'মা কি করবো বলো? আমি তো এতোসব জানতাম না! তার উপরে সোহানকে সবার সামনে পরিচয় দিবে তনু এটা নিয়ে আমার ভিতরে অনেক জেলাস হচ্ছিল। তাই রাগের মাথায় তনুর ইজ্জতে আঘাত করে বসেছি।'
--'এখন কি করবি তুই? এমনিতেই মেয়েটা তোর উপরে অভিমান করে ছিল। তার উপরে আজকে যা করলি তাতে তো সে আরো দূরে সরে যাবে তোর থেকে।'
--'মা হ্যাঁ আমি ভুল করেছি। তবে তাকে আমি আমার থেকে দূরে সরতে দিব না।'
--'জানিনা কি ভাবে কি করবি! তবে মেয়েটাকে ভালোবাসা দিয়ে যে ভাবে হোক নিজের কাছে আগলে নে। না হয় কিন্তু সে যদি কোনো কারণে হারিয়ে যায়, তাহলে কিন্তু তোকেই কষ্ট পেতে হবে।'
--'মা তুমি টেনশন করো না। আমি তনুকে ভালোবাসা দিয়ে আগলে নিব।'
--'আচ্ছা এবার গিয়ে কাপড় পাল্টে নে।'
--'আচ্ছা।'
আকাশ নিজের মা'য়ের সাথে কথা বলে নিজের রুমে চলে যায়। অপরদিকে তনুও আকাশকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে যায়। রুমের দরজা আঁটকে বসে আছে তনু্। মাথা ভর্তি রাগ উঠে আছে তনুর। আকাশ আজকে তনুকে সকলের সামনে যে ভাবে অপমান করেছে সেটা তনু কোনো ভাবেই ভুলতে পারছে না। আসাদ সাহেব এবং পার্টিতে উপস্থিত থাকা সকলের কাছে তনুর একটা সম্মান ছিল। কিন্তু আকাশ মুহূর্তেই মধ্যেই সেই সম্মানটা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। রাগে তনুর ইচ্ছে করছে নিজের মাথার সমস্ত চুল নিজেই টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। কারণ তার সম্মানহানি হওয়ার পিছনে আকাশে সাথে সাথে সে নিজেও দায়ী। সে যদি আকাশকে পার্টিতে নিয়ে না যেতো আর সবার সামনে আকাশকে তার বয়ফ্রেন্ড বলে পরিচয় না করাতো, তাহলে আজকে তাকে আর খারাপ সময়ের মধ্যে পড়তে হতো না। তিলে তিলে গড়া সম্মানে আজকে তার দাগ লেগেছে। তনু মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় সে আকাশকে কখনোই ক্ষমা করবে না। গত পাঁচ বছর আগের জন্য আকাশের উপরে তো প্রতিশোধ নিবেই, সেই সঙ্গে আজকের করা অপমানের জন্যেও সে আলাদা করে আকাশের উপরে প্রতিশোধ নিবে। আর প্রতিশোধটা সে যেমন-তেমন ভাবে নিবে না। সঠিক সময় মতন সে কড়া গন্ডায় আকাশের উপরে প্রতিশোধটা তুলবে। তনু সব কিছু সময়ের আওতায় ছেড়ে দিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। অযথা এখন ঐসব বিষয় নিয়ে ভেবে তনু আর মাথা নষ্ট করতে চাচ্ছে না। নিজেকে শান্ত করে রাতটা কাটিয়ে দেয়। পরেরদিন অফিসে গিয়ে চুপচাপ নিজের কেবিনে চলে যায় তনু। অন্যদিকে কেবিনে ঢুকার আগে এক নজর হলেও আকাশের দিকে তাকায়। কিন্তু আজকে আকাশের দিকে কোনো প্রকার না তাকিয়ে কেবিনে চলে যায়। আকাশ নিজের ডেস্কে বসে ছিল। তনু তার দিকে না তাকিয়ে কেবিনে ঢুকে যাওয়ায় বিষয়টা আকাশের কাছে কেমন যেনো লাগে। আকাশ সোজা ডেস্ক থেকে উঠে তনুর কেবিনে চায়। আকাশ তনুর কেবিনে যাওয়ায় তনু আকাশকে বলে,
--'জ্বি বলুন কি কারণে কেবিনে এসেছেন?'
আকাশ তনুর মুখে আপনি ডাকটা শুনে চমকে উঠে। যেই তনু তাকে তুই ছাড়া কথাই বলতো না, সেই তনু এখন আকাশকে আপনি বলে সম্মোধন করছে। আকাশ আশ্চর্য হয়ে তনুকে প্রশ্ন করে,
--'ম্যাডাম আপনি হটাৎ আমাকে আপনি করে ডাকছেন যে? আপনি তো আমাকে তুই ছাড়া কথাই বলতেন না।'
--'সেই বিষয়ে আপনার না জানলেও চলবে।'
--'ম্যাডাম না জানলে কখনোই চলবে না। আমার জানতেই হবে। আর আপনি আমাকে আপনি করে ডাকলে আমি আপনাকে তুমি করে ডাকবো।'
--'সেটা আপনার ব্যাপার। তবে আজ থেকে আপনাকে আমি আপনি বলেই ডাকবো।'
--'তনু এটা কেমন কথা বলছো তুমি? আমি তোমার মুখ থেকে তুই বলে ডাক শুনতে অভ্যস্ত। কিন্তু এখন হুট করেই আপনি ডাকছো। আমার কাছে না বিষয়টা কেমন যেনো লাগছে!'
--'আপনার কেমন লাগছে আর কেমন লাগছে না সেটা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি এখন থেকে আপনি বলেই ডাকবো। আর আমি আপনাকে তুই বলে ডাকতাম অন্য কারণে।'
--'অন্য কারণটা কি তনু?'
--'কারণ হচ্ছে আপনাকে আমি পছন্দ করতাম। আপনার উপরে শত অভিমান দেখালেও মনে মনে আপনার জন্য ঠিকই ভালোবাসা ছিল। আর মানুষ মানুষকে কেন তুই বলে ডাকে সেটা আমি সঠিক বলতে পারবো না। হয়তো কেউ রাগ করে ডাকে। না হয়তো অন্য কোনো কারণ ও থাকতে পারে। তবে আমি যাদেরকে তুই বলে ডাকি, তাদেরকে মন থেকে ভালোবাসি বলে তুই বলে ডাকি। আমার তুই ডাকার পিছনেও ভালোবাসা থাকে। আর আপনাকে এতোদিন আমি তুই বলে ডাকতাম আপনাকে ভালোবাসি বলে। কিন্তু গতকালের পর আপনার উপর থেকে সমস্ত ভালোবাসা শেষ হয়ে গিয়েছে আমার। ভিতরে যে টুকু ভালোবাসা ছিল আপনার জন্য, সব উপড়ে বেরিয়ে গেছে আপনার গতকালের আচরণের কারণে। তাই আজ থেকে আপনাকে আমি আপনি বলেই ডাকবো। এবার বলুন কি কারণে এসেছেন কেবিনে?'
--'তনু আসলে গতকালের জন্য আমি সরি।'
--'আরেহ আকাশ সাহেব আপনি সরি বলছেন কেন? দোষটা তো আমি করেছি। গতকাল আপনাকে না নিয়ে গেলে এবং সবার সাথে ঐরকম ভাবে পরিচয় করিয়ে না দিলে কখনোই আমাকে ঐ পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। তাই দোষ যা করার আমিই করেছি।'
--'তনু প্লিজ অভিমান করো না। আসলে সোহানের বিষয়টা আমি মানতে পারছিলাম না। খুব জেলাসি হচ্ছিল নিজের ভিতরে এবং সেই সঙ্গে রাগ ও উঠেছিল তাই আসলে না বুঝে ঐরকমটা করে ফেলেছি। আর আমি ঐ সময় ভাবতেও পারিনি, যে আমার ঐরকম করার কারণে তোমার সম্মান নষ্ট হবে। রাগের মাথায় যা ভালো মনে হয়েছে তাই করে ফেলেছি। প্লিজ তুমি আর অভিমান করে থেকো না।'
--'আকাশ সাহেব প্লিজ টপিক টা বাদ দিন। আর যা হয়েছে সেটা গতকাল চলে গিয়েছে। আমি আর এই টপিক নিয়ে কথা বলতে চাই না। আপনার আর কোনো কাজের কথা থাকলে সেটা বলুন। না হয় নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে থাকুন।'
তনু আকাশকে চলে যেতে বলে। কিন্তু আকাশ না গিয়ে উল্টো তনুর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। এরপর তনুকে বলে,
--'চেয়ার থেকে উঠো।'
--'মানে কি?'
--'মানে হলো চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াও।'
--'আজব চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াবো কোন কারণে?'
--'কারণ আমি তোমাকে দাঁড়াতে বলেছি। তাই তুমি উঠে দাঁড়াবে।'
তনু আকাশের কথা মতন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়৷ এরপর আকাশকে প্রশ্ন করে,
--'হুম দাঁড়িয়েছি। এবার বলুন কি কারণে আপনি আমাকে দাঁড়াতে বলেছেন।'
আকাশ তনুর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তনুর চেয়ারটা হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে কিছুটা দূরে সরায়৷ তারপর হুট করেই তনুকে বুকে টেনে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
--'তনু আমি সত্যিই সরি। তনু আমি কখনোই চাইনি তোমাকে কষ্ট দিতে। কিন্তু যা হয়েছে তার জন্য আমি সত্যিই অনুতপ্ত। এবং ক্ষমাও চাচ্ছি তোমার থেকে। তনু তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। আর এই যে নাও তোমাকে শক্তি করে জড়িয়ে ধরলাম। আগামীতে আর কখনো তোমাকে আমি কষ্ট দিব না। সব সময় এভাবে আগলে রাখবো। প্লিজ তুমি আমার উপরে আর অভিমান করে থেকো না।'
তনু খনিকের জন্য থমকে যায় আকাশের আচরণে। সেই সঙ্গে তনুর ভিতরেও কেমন যেনো এক ধরনের শিহরণ হচ্ছে। তনুর শ্বাসপ্রশ্বাস ঘন হয়ে গিয়েছে। তনু এক প্রকার আঁটকে গেছে আকাশের মায়াজালে। তবে কিছু সময় পর তনু নিজের মনকে সামলে নিয়ে আকাশকে বলে,
--'ছাড়ুন আমায়। আপনার ভালোবাসা আর দরকার নেই আমার। আপনার কাছ থেকে এই জীবনে অপমান ছাড়া আর কিছুই পাইনি। পাঁচ বছর আগে না হয় যা করেছেন সেটা বাদ দিলাম। কিন্তু গতকাল যা করেছেন সেটার জন্য আমার মান-ইজ্জত ধুলোয় মিশে গেছে। এক চুটকিতেই সব শেষ করে দিয়েছেন আপনি৷ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজের একটা অবস্থান তৈরী করেছি। কিন্তু আপনি সব শেষ করে দিয়েছেন। আমার আর আপনাকে চাই না। ছাড়ুন আমায়।'
--'তনুকে তোমাকে ছাড়ার উদ্দেশ্যে ধরিনি। আজীবন আগলে রাখার জন্য ধরেছি তোমাকে। তনু আমিও তোমাকে ভালোবাসি। আগামীতে আর কখনো তোমার মান- সম্মানে আঘাত লাগে এমন কোনো কাজ আমি করবো না।'
--'আগামীতে না হয় করবেন না। কিন্তু গতকাল যেটা করেছেন সেটার কি হবে? আসাদ সাহেবের কোম্পানি আর আমার কোম্পানি মিলে একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছি। যার দরুন উনার সাথে আমার আরো বহুবার দেখা হবে। কিন্তু আমি আগামীতে আসাদ সাহেবের সামনে কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবো বলতে পারেন?'
--'না আমার জানা নেই আমার কি করা উচিত! তবে বিশ্বাস করো আমার তোমাকেই লাগবে। আর আমার তোমাকেই চাই।'
--'কিন্তু আমার আপনাকে চাই না মানে চাই না। কাউকে প্রয়োজন নেই আমার। এবার ছাড়ুন আমায়।'
তনু আকাশকে ছেড়ে দিতে বলে। কিন্তু কে শুনে কার কথা। তনু আকাশকে এখনো নিজের কাছে জিম্মি করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। আকাশ তনুকে না ছাড়ায় তনু নিজেই এবার জোড়াজুড়ি করতে থাকে ছাড়া পাওয়ার জন্য। কিন্তু তনু যতো ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করে, আকাশ ততোই তনুকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। এমন সময় হুট করে অফিসের ম্যানেজার খালেক সাহেব কোনো একটা কারণে তনুর কেবিনের দিকে আসে। খালেক সাহেব তনুর কেবিনের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকার জন্য অনুমতি নিতে যাবে, তখনি সে দেখে আকাশ তনুকে জোরপূর্বক জড়িয়ে ধরে রেখেছে। খালেক সাহেব এই দৃশ্য দেখে অনুমতি ছাড়াই তনুর কেবিনের ভিতরে প্রবেশ করে দু'জনের কাছে চলে যায়। এরপর আকাশ থেকে তনুকে ছাড়িয়ে নিয়ে আকাশের কলার চেপে ধরে বলতে শুরু করে,
--'এই বেয়াদব তোর কত্তো বড় সাহস তুই ম্যাডামের সাথে জোড়াজুড়ি করিস অশ্লীলতা করার জন্য? দাঁড়া তোর আজকে খবর আছে। এখন তোকে অফিসের সবার সামনে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে আবার অপমান করবো। তারপর কোষে একটা মা'ইর দিব। চল তুই আমার সাথে।'
ম্যানেজার আকাশের কলার ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য এক কদম সামনে পা ফেলতেই তনু সজোড়ে চেঁচিয়ে বলে উঠে,
--'খালেক সাহেব এই মুহূর্তে ওর কলার থেকে হাত নামান। না হয় আপনার হাত আমি কব্জি থেকে কে'টে দু’টুকরো করে ফেলবো। আপনি কোন সাহসে ওর গায়ে ওর গায়ে হাত দিয়েছেন? এতো বড় আস্পর্ধা কি করে হয়েছে আপনার?
খালেক সাহেব পুরো থতমত খেয়ে যায় তনুর কথায়। তিনি তনুকে বাঁচাতে আসলো, কিন্তু তনু তাকেই উল্টো ঝাড়ি দিতে শুরু করেছে। খালেক সাহেবের মতন আকাশ ও থতমত খেয়ে যায় তনুর কথাবার্তা শুনে। কারণ সে তনুকে জোরপূর্বক জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। তনুর তাকে এখন বাটাম দেওয়ার কথা। কিন্তু তনু তা না করে উল্টো অফিসের ম্যানেজার খালেক সাহেবকেই বকছে। খালেক সাহেব আর আকাশ দু'জনেই হতভম্ব হয়ে তনুর দিকে তাকিয়ে আছে। তনুর কথাবার্তা সব কিছুই কেমন যেনো তাদের মাথার উপর দিয়ে
যাচ্ছে.......

Post a Comment

Previous Post Next Post

نموذج الاتصال