ভয়াল রাতের আর্তনাদ|ভুতের গল্প vuter golpo


 ট্রেনের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখি রাস্তার দুই ধারের গাছগুলো ট্রেনের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছে। দুপুরে খবর এসেছে ফুপু অসুস্থ । তাই অফিস শেষ করেই রওয়ানা দিয়েছি। যদিও নিমতলা যেতে এখনও ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগবে। তারপর সেখান থেকে টমটমে করে ফিঙ্গে মোড় যেতে হবে। সেখান থেকে আবার রিকশা করে সোজা মিয়াপুর গ্রামে। যদিও অনেক আগে একবার গিয়েছিলাম ফুফুর বাড়িতে তবুও কীভাবে যেতে হবে সেটা দিব্যি মনে আছে।

ট্রেন যখন নিমতলা ষ্টেশনে এসে পৌঁছালো তখন ঘড়িতে রাত প্রায় নয়টা বাজে। অজপাড়াগাঁয়ের ষ্টেশন। মানুষজনের তেমন আনাগোনা নেই। তাছাড়া আজকের আবহাওয়া কেমন যেন গুমোট বাধা। মনে হচ্ছে যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখেছে প্রকৃতি। ঝড় তুফানের পূর্বাভাস। রাতের শেষ টমটমে করে এসে পৌঁছালাম ফিঙ্গে মোড়। আমি বাদে আর কেউ নামলো না টমটম থেকে। রাস্তায় কোনো জনমানব নেই। ইতিমধ্যে জোর বাতাস বইতে শুরু করেছে। রাস্তার মোড়ে শুধুমাত্র একটা চায়ের দোকানে লণ্ঠনে মৃদু আলো জ্বলছে। দোকানের সামনে গিয়ে দেখি দোকানদার দোকান বন্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলাম,"ভাই, মিয়াপুর যাওয়ার জন্য কোনো রিকশা পাওয়া যাবে এখানে?"
লোকটা আমার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলো,"না মশাই, এত রাতে কোনো রিকশা পাবেন না।"
" তাহলে ফুফুর বাড়িতে যাবো কীভাবে?" বিড়বিড় করে বললাম। লোকটা আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,"হেঁটে চলে যান। এছাড়া কোনো উপায় নেই। মিনিট ত্রিশের হাঁটা পথ।"
"হেঁটে যাবো ! কিন্তু পথই তো চিনি না, কিছুটা হতাশ কণ্ঠে বললাম।
লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,"একদম সোজা পথ। ঐ পুবের পথ ধরে সোজা হাঁটবেন। দশ মিনিট হাঁটার পর উত্তর দিকে আরও একটি চিকন মাটির রাস্তা পাবেন। ঐ রাস্তা ধরে সোজা হাঁটলেই মিয়াপুর।"
লোকটার কথা শেষ হতে না হতেই জোরে বৃষ্টি পড়া শুরু করলো। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম কিন্তু বৃষ্টি কমার কোনো লক্ষণ ই নেই। এদিকে দোকানদারও তার দোকান বন্ধ করার জন্য তাড়াহুড়ো করছে। শেষে দোকানদারের কাছ থেকে একটা পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে সেটা মাথায় বেঁধে হাঁটা শুরু করলাম। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁই ছুঁই। রাস্তার দুই ধারের গাছগুলো বাতাসে দুলছে। বৃষ্টির পানিতে আমার পুরো শরীর ভিজে গেছে। শার্ট চুইয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। আমি অবশ্য দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করছি। রাস্তার দুই পাশে পুকুর,জঙ্গল,ক্ষেত। বাড়িঘর চোখের দৃষ্টিতে পড়লো না। ডানদিকের রাস্তায় ঢুকতেই কেমন যেন অস্বস্তি লাগলো আমার। এখানে মনে হচ্ছে অন্ধকার একটু বেশিই। ভাগ্য ভালো সাথে টর্চ ছিল। টর্চের আলোতে পথ চলতে তেমন সমস্যা হচ্ছে না। তবে বৃষ্টির পানিতে মাটির রাস্তা কর্দমাক্ত হয়ে গেছে তাই সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। হঠাৎ পেছন থেকে পরিচিত একটা কণ্ঠ শুনতে পেলাম। পিছনে ফিরে দেখি ফুফু দাঁড়িয়ে আছে । আমি অবাক হয়ে বললাম,ফুফু! আপনি এখানে?
ফুফু মৃদু হেসে বলল,"হ্যাঁ বাবা, তুই আসবি শুনে তোকে এগিয়ে নিতে আসলাম।"
আমি কিছুটা খুশি হয়ে বললাম,"ভালোই করেছেন। আমারও একা যেতে অস্বস্তি লাগছে। তাছাড়া বৃষ্টিতে পথ আরও... কথা বলতে বলতে আমি কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলাম। আবার পেছনে তাকিয়ে দেখি ফুফু নেই। এবার সত্যিই আশ্চর্য হলাম। জোরে ফুফু বলে ডাক দিলাম বেশ কয়েকবার। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। শুধু বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ ও বৃষ্টির শব্দ কানে বাজছে। হাত পা ভয়ে কাঁপলেও মনে সাহস সঞ্চার করে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার ও বৃষ্টির মাঝে টর্চের সামান্য আলোতে কোনোরকমে পথ চলছি আমি। হঠাৎ দেখি সামনে রাস্তার পাশে সাদা কাপড় পরা কেউ একজন মাটি খুঁড়ছে। আমি কাঁপা কণ্ঠে জোরে জিজ্ঞাসা করলাম, কে?
আমার ডাক শুনে সে পিছনে ফিরে আমার দিকে তাকালো। এরকম ভয়ংকর বীভৎস চেহারা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। কেউ হয়তো দুঃস্বপ্নেও এরকম কিছু দেখে না। সাদা কাপড় পরা মহিলাটার মুখে যেন খুবলে খাওয়া মাংসপিণ্ড ঝুলছে। রক্ত জমে কালো হয়ে গেছে। এত অন্ধকারেও টকটকে লাল চোখ দুটো স্পষ্ট দেখতে পেলাম। তার মুখে মৃত মানুষের মাংস। আমার দিকে তাকিয়ে বীভৎস একটা হাসি দিল। ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবো মনে হচ্ছে। মৃত্যুর এত বীভৎস রূপ আগে কখনো দেখি নি আমি। জ্ঞান হারালে মৃত্যু অনিবার্য একথা মনকে বুঝিয়ে কোনোরকমে জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে ছুটলাম। একবারের জন্যও পিছনে ফিরে দেখার কথা ভাবছি না। তবে এত রাতে কোথায় যাবো সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না। এদিকে টর্চও হাত থেকে পড়ে হারিয়ে গেছে। ঊর্ধ্বশ্বাসে জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে ছুটছি। পেছনে এক ভয়ংকর অশরীরীর মৃত্যু ফাঁদ! মনে শুধু একটাই চিন্তা আমি কী দৌঁড়ে বাঁচতে পারবো এই মানুষখেকো অশরীরীর হাত থেকে?
কতক্ষণ ধরে দৌঁড়াচ্ছি আন্দাজ করতে পারছি না। কোনদিকে দৌঁড়াচ্ছি সেটাও বুঝতে পারছি না। বৃষ্টির প্রকোপ কিছুটা কমে এসেছে এখন। দৌঁড় থামালাম একটা কুঁড়েঘর দেখে। মিটিমিটি আলো জ্বলছে ঘরে। দৌঁড় থামিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে লাগলাম। ভেতর থেকে একজন মাঝ বয়সী মহিলা বের হয়ে আসলো। অল্প আলোতেও স্পষ্ট বুঝতে পারলাম তার গায়ের রং কুচকুচে কালো। অনুরোধের স্বরে তাকে বললাম,"আমি খুব বিপদে পড়েছি। আমাকে দয়া করে সাহায্য করুন।"
মহিলাটা বিড়বিড় করে বলল,"আমি জানতাম তুমি এখানেই আসবে।"
আমি তার কথায় কর্ণপাত না করে পুনরায় বললাম,"আমাকে এই বিপদে দয়া করে সাহায্য করুন। আমি এখানকার পথ ঘাট কিছুই চিনি না।"
মহিলাটা আবার ও বিড়বিড় করে বলল,"যে বিপদে মৃত্যু আসে সে বিপদ থেকে কেউ মুক্ত হতে পারে না।"
আমি কথাটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলাম,"কিছু বললেন?"
সে কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বলল,"আসো ঘরের ভেতর আসো।"
আমি ঘরে ঢুকতেই সে আমাকে এক টুকরো কাপড় দিয়ে বলল,"শরীর মুছে নাও। পাশের রুমে বিছানা আছে, শুয়ে পড়ো। খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই।"
আমি ধন্যবাদ বলে পাশের রুমে চলে আসলাম। মহিলাটাকে ভীষণ অদ্ভুত লাগছে। কথাবার্তাও কেমন রহস্যময়! তবে আজ রাত আশ্রয় পেয়েছি এটাই অনেক। বিপদের হাত থেকে তো বাঁচলাম। কাল সকালে আলো ফুটতেই বের হয়ে যেতে হবে। মিয়াপুর গ্রাম যে কোথায়! সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ মনে হল কেউ একজন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার চুলে হাত বুলালো ভীষণ কুচকুচে কালো একটা হাত। আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। অশরীরীর উপস্থিতি টের পাচ্ছি। কেমন একটা জমাট বাঁধা রক্তের বিদঘুটে গন্ধ নাকে আসছে। চোখ খুলে দেখি কেউ নেই আমার পাশে। চারপাশের ছনের বেড়া থেকে রক্ত ঝরছে। কানে বাজছে ভয়ংকর আর্তনাদ, মৃত্যুর আর্তনাদ। হঠাৎ মনে হল আমার পিছনে কেউ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ভারী নিঃশ্বাস স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম। মানুষখেকো সেই মহিলার বীভৎস চেহারা। পৈশাচিক হাসি মুখে, মুখে এখনও মানুষের মাংস। দমবন্ধ হয়ে আসলো আমার। লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। উফফ কী ভয়ানক দুঃস্বপ্ন!এত বীভৎস হতে পারে স্বপ্ন! চারপাশে সবকিছু এখন ঠিক আছে। ঘড়িতে তিনটা তিন বাজে। সকালের আলো ফুটতে এখনও ঢের দেরী। এদিকে দুঃস্বপ্নের ভয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করতে পারছি না। তখনই পাশের রুম থেকে খুটখুট শব্দ শুনতে পেলাম। কৌতুহলী হয়ে উঁকি দিয়ে দেখি পাশের রুমে সেই মহিলা মানুষের কাঁচা মাংস চিবুচ্ছে। মৃত লাশটা উপরে বাঁশের সাথে ঝুলছে। পেট গুলিয়ে উঠলো আমার। ভয়ে মুখ থেকে টুঁ শব্দ বের হচ্ছে না। আশ্রয় নিতে এসে নিজেই শিকার হবো এমনটা ভাবি নি। নিঃশব্দে হেঁটে আমার রুমের বেড়াতে ফাঁক ফোকর খুঁজতে লাগলাম। একদিকে কিছুটা ছন খসে পড়ে আছে। সে জায়গায় থাবা দিয়ে ফাঁক আরও বড় করে কোনোরকমে বের হয়ে আসলাম। তারপর উদ্দেশ্যহীন ভাবে দৌঁড় শুরু করলাম। বুঝতে পারলাম পিছনে কেউ আমাকে ফলো করছে। বাতাসে জঙ্গলের গাছ দুলছে। পায়ের রগ টনটন করছে আমার। তবুও দৌঁড় থামালাম না। জানি থামলেই মৃত্যু। হঠাৎ ডানপাশে একটা গাছের দিকে চোখ পড়তেই হতবাক হয়ে গেলাম। আমার লাশই ঝুলছে গাছে। এক মূহুর্ত স্থির হলাম। পরক্ষণেই মনে হল এটা আমার জন্য একটা মৃত্যুফাঁদ। আবার ছুটতে লাগলাম। এখন আমার সামনে পিছনে বামে ডানে সমস্ত গাছে শুধু আমার লাশ ঝুলছে। আমি চোখ বন্ধ করে ছুটছি। আস্তে আস্তে কমে এলো গাছপালা। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে লোকালয়ে এসে পৌঁছালাম। ঝড় তুফান থেমে গেছে এখন। কোনো এক বাড়ির উঠানে এসে মাটিতে বসে পড়লাম। চোখে কিছুই দেখছি না। পা আর নড়ছেই না। মাথা বনবন করছে। আর টিকতে পারলাম না। জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান ফিরতে দেখি আমি ফুফুর বাড়িতে শুয়ে আছি। আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমার ফুফু, ফুফা, ফুফাতো ভাই। সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম তাদের। ফুফু বলল,"এই জঙ্গলটা ভয়ংকর অশরীরীদের আস্তানা। সন্ধ্যার পর আর কেউ এই রাস্তায় আসে না। আমি যদি জানতাম তুই রাত করে আসবি তাহলে নিষেধ করতাম আসার জন্য। এখন বিশ্রাম নে। অনেক ধকল গেছে তোর উপর। আমি এখন সুস্থ আছি মোটামুটি।"
পরম নিশ্চিন্তে চোখ বুজলাম আমি ।তবে কানে এখনও বাজছে ভয়াল রাতের আর্তনাদ।

Post a Comment

Previous Post Next Post

نموذج الاتصال