আনোয়ারা কাজ শেষ করে হাটের দিকে ছুটে চলেছে। বাজার নিয়ে বাড়িতে আসবে। বাড়িতে তার দুই মেয়ে, এক ছেলে। ছেলেটা সবার ছোট। ছয় বছর বয়স। কথা বলতে পারে না। বড় মেয়ের নাম আদুরী। মেজো মেয়ের নাম রানী। আনোয়ারার স্বামী আশরাফ মিয়া দুই বছর আগে মারা গেছে। স্বামীর রেখে যাওয়া ভিটেতেই ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকে আনোয়ারা। কাজ করে মাটি কাটার। প্রতিদিন পাঁচটায় কাজ শেষ হলেও আজ ছয়টা বেজে গেছে। গ্রামের রাস্তা ধরে বাজার শেষে হাঁটতে শুরু করে। ঘন্টাখানেক লাগবে বাড়িতে আসতে।আজ আনোয়ারা একটু ক্লান্ত। হেঁটে আসতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। পায়ে কোদালের আঘাত পেয়েছে। বেশ খানিকটা কেটে রক্ত গলগলিয়ে পড়েছে। শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে কোনরকম বেঁধে রক্ত পড়া বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। তখন ব্যথার তীব্রতা না বুঝলেও এখন হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে। গায়ে ঠান্ডা লাগতিছে। জ্বর আসবে বোধহয়।
মায়ের ফিরতে দেরী হওয়াতে আদুরী ভাইবোনকে নিয়ে মেজোচাচা আকরাম মিয়ার কাছে গেছে সাহায্যের জন্য। আকরাম মিয়ার বাড়ি আদুরীদের থেকে মিনিট দুয়েক দূরে।আকরাম মিয়া বের হয়ে রাস্তায় আসে।একটু পথ এগুতেই দেখে আনোয়ারা খুড়াতে খুড়াতে বাড়ির দিকে আসছে। বাড়ির ঠিক সামনে আসতেই আনোয়ারা পড়ে যায়। শরীর আর সায় দিচ্ছিল না। অচেতন হয়ে পড়েন। আকরাম মিয়া আদুরী বলে চিৎকার করে ডেকে উঠলো। আদুরী আতংকে বের হয়ে আসে। একটু সামনে আসতেই দেখে আকরাম মিয়া তার মাকে উঠানোর চেষ্টা করছে। আদুরী দৌড়ায়ে মায়ের কাছে এসে জড়িয়ে ধরে মাকে। কাঁদতে কাঁদতে ঘরে নিয়ে আসে মাকে। রানী আর সূর্য আসে পিছন পিছন। আকরাম মিয়া চলে যায় ডাক্তার ডাকতে। পাড়ার মোড়ে হাকিম নামের একজন গ্রাম্য ডাক্তার আছে। ছোটখাটো সমস্যায় সবাই তার কাছেই যায়।
ডাক্তার এসে জ্বর মাপে। ততোক্ষণে জ্বর একশো চারে উঠে গেছে। ডাক্তার পা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দেয়। ব্যথা আর জ্বরের ওষুধ দিয়ে বললো সকালের মধ্যে জ্বর না কমলে তাকে যেন জানানো হয়।আদুরীকে মাথায় পানি ঢালতে বললে আদুরী মায়ের মাথায় পানি দিতে লাগলো। কিছুক্ষণ বাদে জ্বর কমে আসলে আদুরী ভাত উঠায়ে দেয়। ভাত হয়ে গেলে ভাইবোনকে খাওয়ায়ে মাকেও খাওয়ায় দেয়। ওষুধ খাইয়ে দিয়ে মায়ের মাথায় পরম আদরে হাত বুলাতে থাকে। আনোয়ারা ঘুমিয়ে পড়েন।
সকালে আনোয়ারার শরীর বেশ ভালো হয়ে যায়। আনোয়ারা সুস্থ বোধ করলেও পায়ের ব্যথা কমেনি। তাই আর কাজে যাওয়া হয়নি। আনোয়ারা চোখ বন্ধ করে শুয়েই আছে। মাথায় হাজার রকমের চিন্তা।আদুরীর বয়স উনিশে পড়েছে। রানীর চৌদ্দ। আনোয়ারার স্বামীর অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। ভিটের জায়গা বাদে আর কোন জমি নেই। তার মৃত্যুর পর পর তাই আনোয়ারাকে কাজের খোঁজে বের হতে হয়। মাটি কাটার কাজ করে সংসার সামলায়। আদুরীর বিয়ের ভাবনাটা এই মূহুর্তে আনোয়ারাকে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত করে। তার কিছু হয়ে গেলে ছেলে মেয়ের কি হবে ভেবেই কাটা দিয়ে উঠে আনোয়ারার শরীর। ভিতরে দুমড়েমুচড়ে যায়। চোখ বেয়ে জল নেমে পড়ে।
বেলা এগারোটায় আকরাম মিয়া আসে আদুরীদের বাড়ি। আনোয়ারার ঘরে ঢুকে তার শরীর কেমন আছে জিঙ্গাসা করে। আকরাম মিয়াও বেশ চিন্তিত। আনোয়ারাকে বলে উঠলো, ভাবী আপনি তো জানেন আমার অবস্থা। আমি যে আপনাদের সাহায্য সহযোগিতা করবো সেটা হয়ে উঠে না। সুমির মা অশান্তি সৃষ্টি করে। মেয়েডাও বড়ো হয়েছে। আর কতদিন রাখবেন। জেদ কইরেন না। কতোগুলো ঘর আসলো। যৌতুক ছাড়া কেউ তো ঘরে নিতে চায় না। আপনি মাতব্বরের সাথে আদুরীর বিয়াডা দিতে রাজি হন। আনোয়ারা চোখ তুলে তাকায় আকরাম মিয়ার দিকে। কোন উত্তর করে না। আকরাম মিয়া আরো কিছু কথা বলে বের হবার সময় দেখে আদুরী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কাঁদতিছে। হঠাৎ আকরাম মিয়ার পা জরিয়ে ধরে আদুরী। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে চাচাকে বলে, মেজোআব্বা আপনি মাতব্বরকে বলেন আমি তাকে বিয়ে করতে রাজি। আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব ব্যবস্থা করেন। মাকে আমি বুঝিয়ে নিব। আকরাম মিয়া আদুরীর দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আনোয়ারার চোখ বেয়ে জল নামতে থাকে। ভয়, আতংক, সন্দেহ, ঘৃনা, রাগ মিশানো এক তীব্র যন্ত্রনায় ছটফট করে আনোয়ারা।
আছরের নামাজ শেষে আদুরী ভাত উঠায়ে দেবার জন্য পাতিলে চাল নিয়ে ধুতে কলপাড়ে যায়। চাল ধুয়ে চুলায় চড়ায় দেয়। আদুরীদের বাড়িতে দুইটা ঘর। ঘরের সামনে একটু ছোট উঠান। উঠানের একপাশে কলপাড়, অন্যদিকে রান্নাঘর।রানী দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ি আসে। হাঁপিয়ে উঠেছে। আদুরী বললো, কিরে দৌড়াস ক্যান? হাঁপাতে হাঁপাতে রানী বললো, আসার সময় দেখলাম মেজোআব্বা মাতব্বরকে নিয়ে আসতিছে। সঙ্গে আরো কয়েকজন লোক। আদুরীর বুকটা হুহু করে উঠলো।
মেজোআম্মা, প্রতিবেশি দু একজন খালা চাচিরাও বাড়িতে চলে এসেছে। মাতব্বর, মেজোআব্বা উঠানে চেয়ারে বসে আছে। একজন আদুরীকে একটু সাজাতে গেলে আদুরী না করে দেয়। নাস্তা মেজোআম্মা সাথে নিয়ে আসছিলো, ঐটাই খেতে দেওয়া হইছে। আনোয়ারার শরীরটাও একটু ভালো লাগছে। সে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। পা অনেকটা ফুলে আছে। তাই ঘর থেকে বের হচ্ছে না।ঘরে আদুরী ঢুকতেই মা মেয়ের চোখাচোখি হলো। আনোয়ারার চোখ বড্ড শীতল হয়ে আছে। চোখে মায়া, অপরাধবোধ। আদুরী মাটির চৌকির একপাশে বসলো। মাকে বললো, মা আমাকে ক্ষমা করে দিও। মাতব্বরকে বিয়ে করলে অনেক কিছুর সমাধান হয়ে যাবে। তোমার শরীর ভালো না। আর কতদিন মাটি কাটার কাজ করে আমাদের পেটে ভাত দিবে। কপালে যা আছে তাই হোক। আর কতো!! অনেকদিন হয়ে গেলো একটাই সমস্যা। আব্বাকেও হারালাম। কথাগুলো চাপাকন্ঠে বড্ড ঠান্ডা স্বরে থেমে থেমে বললো।আনোয়ারার চোখ আর্দ্র হয়ে উঠেছে। কিছু বলছে না। মানুষকে পরিস্থিতি মাঝেমাঝে বাকরুদ্ধ করে তুলে। চাইলেও কোন শব্দ বের করতে পারছে না আনোয়ারা। চোখ বেয়ে টপটপ করে জল গড়ে পরতিছে শুধু।আদুরী মাথায় উড়না টেনে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। মেজোআম্মা ওকে মাতব্বরের সামনে নিয়ে গেলো। মাতব্বর কোন কথা না বলে জানিয়ে দিলো আজ এশার নামাজের পর বিয়ে। কোন অবস্থাতেই উনি আর দেরি করতে চায় না। আদুরীর বুক কেঁপে উঠলো। চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরতিছে। রানী বড়ো আপাকে জড়িয়ে ধরলো।।ছোট্ট সূর্যও কাঁদছে। বিধাতা এই পরিবারের প্রতি আজ বড়ই নির্দয়। সবার বুকফাটা আর্তনাদ। আকরাম মিয়ার চোখও বাঁধ মানছে না।
মাতব্বর আজ অনেক খুশি। অনেক চেষ্টার পর আদুরী নামক মোহকে আজ সে নিজের করে পাবে। কতকিছুই না করলো তাকে পাওয়ার জন্য। শ্যামবর্না আধবয়সী এক মেয়ের জন্য দুই বছরে কত কিছুই করতে হলো। আজ সে সফল। আত্মতৃপ্তির হাসি হাসছে শাজাহান মাতব্বর। একই ঘটনায় কেউ হাসছে তো কেউ কাঁদছে। সৃষ্টির লীলা খেলা বড়ই আজব।
Tags
ছোট গল্প