-এই মধ্যরাতে রাস্তায় দাড়িয়ে আছি, কোলে একটি ছোট্ট অবুঝ মেয়ে। কোথায় যাবো কোনদিক যাবো কি করবো কিছুই মাথায় ঢুকছেনা।
বাসে আমার পাশের সিটে বসা মেয়েটার ডাকে পিছন ফিরলাম।
-- জি আমাকে বলছেন?
- হুম আপনাকেই বলছি।
মেয়েটি আমার কাছে এসে দাড়াল। তার হাতের আঙ্গুলে থাকা সোনার আংটিটা খুলে আমার কলিজার টুকরা মেয়েটার হাতে পড়িয়ে দিয়ে বলল,
- না জেনে, না বুঝে অনেক কথা বলেছি। হয়তো অনেক কষ্ট পেয়েছেন যদি পারেন ক্ষমা করে দিয়েন।
-- প্লীজ এভাবে বলবেন না। আমার মনে হয়না আপনি কোনো ভুল বলেছেন। আপনার যায়গায় থাকলে আমিও হয়তো এরকমই করতাম। তাই বলছি ক্ষমা চেয়ে প্লীজ আমাকে ছোট করবেন না।
-- সত্যি আপনি অনেক বড় মাপের মানুষ।
বাসের হর্নের শব্দে মেয়েটি বাসে গিয়ে উঠল। বাস চলছে তার নিজ গতিতে। জানিনা এই অপরিচিত মেয়েটির সাথে আর কখনো দেখা হবে কিনা?
আমি রাস্তার সাইড দিয়ে হাটছি অজানা গন্তব্যে। জানিনা কোথায় যাবো।
.
২ বছর পর...
আমার ছোট্ট কলিজার টুকরা মেয়ে হাটতে শিখেছে। আধো আধো কথাও বলতে পারে। আমার মেয়ের নাম রেখেছি টুশি।
টুশি যখন আধো আধো কন্ঠে বাবাই বলে ডাকে তখন নিমিষেই সব কষ্ট ভুলে যাই।
অনেক জায়গায় চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছি কিন্তু কোথাও চাকরি হয়ে উঠেনি।
একটা ইটের ভাটায় কাজ করে কোনো রকমে দিন চালিয়ে যাই।
দিন শেষ বাসায় ফিরে যখন আমার কলিজার টুকরা মেয়েটি বাবাই বলে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে তখন যেন সারাদিন করা পরিশ্রম নিমিষেই দুর হয়ে যায়।
-কিন্তু কিছুদিন থেকে আমার মেয়ে টুশির কিছু পরিবর্তন লক্ষ করছি। মাঝ রাতে চিৎকার করে কেদে উঠে। আর বলে বাবাই আমার মাথাটা খুব ব্যাথা করছে বাবাই আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
আমি টুশিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে মাথা টিপে দিতাম। টুশি কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে যেত।
আমি সারারাত ঘুমোতে পারতাম না, কলিজাটার চোখের জল যে আমি একদম সয্য করতে পারিনা।
এভাবে প্রায় রাতেই টুশি মাথার ব্যাথায় কান্না করে উঠতো, আমি সারারাত জেগে মাথা টিপে দিতাম।
সেদিন সকালে কাজে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি ঠিক এসময়ে টুশি এসে বলল,
- বাবাই আমার আম্মু কোথায়?
টুশির হটাৎ এরকম প্রশ্ন ভিতরটাকে ছারখার করে দিল।
- বাবাই তুমি যে একটা ছবি বুকে নিয়ে কান্না করো ওইটা কি আমার মা।
-- না মামুনি আমিই তোমার মা আমিই তোমার বাবা। আমিই তোমাকে জন্ম দিয়েছি।
- বাবাই তুমি আমাকে একটা আম্মু এনে দিবা? প্লীজ বাবাই এনে দাওনা একটা আম্মু।
আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিনা। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। টুশিকে জড়িয়ে ধরি কদছি। কোথায় পাবো তার আম্মুকে, কিভাবে
আনবো তাকে, সে তো এখন নতুন বিয়ে করে সংসার গোছতেই ব্যাস্ত।
টুশি আমার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে কাদো কাদো কন্ঠে বলতে লাগল,
- প্লীজ বাবা তুমি কেদোনা। আমি আর কখনো আম্মুকে চাইবোনা। তুমি আমার বাবা তুমি আমার মা। তবুও বাবাই তুমি কেদোনা। বাবাই তোমার চোখে পানি দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়।
টুশির এমন কথা শুনে আমার ভেতর থেকে হাউমাউ করে কান্না বেরিয়ে আসলো। আমি যে আজ ব্যর্থ, পারিনি
বাবা হয়ে আমার কলিজার টুকরা মেয়েটির মায়ের অভাব পূরণ করতে। আমি নিজেই নিজের কাছে হেরে গেলাম।
- বাবাই একটা কথা বলবো?
-- হ্যা মামুনি বলো কি বলবে,
- বাবাই আজকে সারাদিন আমার সাথে থাকবে? সারাদিন তোমার সাথে খেলবো। পুতুল খেলবো লুকোচুরি খেলবো আরো অনেক খেলবো। আজ থাকবে বাবাই আমার সাথে?
খাওয়ার মতো ঘরে কোনো চাল নেই। টুশির এই ছোট আবদারটাও রাখতে পারলাম না।
- আজকে না মামুনি অন্য কোন একদিন খেলবো। এখন চলো তোমাকে শুইয়ে দিই, তুমি লক্ষিটির মতো ঘুমিয়ে পড়ো,,
.
কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় বাসায় এসে টুশিকে ডাকছি কিন্তু টুশির কোনো সারা শব্দ নেই।
সারাঘর খুজলাম টুশিকে কোথাও খুজে পাচ্ছিনা। বুকের মধ্যে হাহাকার শুরু হয়ে গেছে।
কোথাও টুশিকে না পেয়ে রান্না ঘরে গিয়ে দেখি টুশি মেঝেতে পরে অজ্ঞান হয়ে আছে।
টুশির মুখে মাথায় পানি দেওয়ার পরেও হুস আসছে না। নিরবেই বুকের ভেতরটা হুহু করে কেদে উঠলো।
আর কিছু না ভেবেই সাথে সাথে টুশিকে নিয়ে হাসপাতালে চলে এলাম।
নার্স এসে টুশিকে নিয়ে গেল, এখনো টুশির জ্ঞান ফিরেনি।
দরজার বাইরে দাড়িয়ে আছি। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে।
নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে খুব, যদি আজ কাজে না যেতাম তাহলে হয়তো টুশির এই অবস্থা হতোনা।
কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বেরিয়ে আসলো।
- ডক্টর আমর মেয়ের কি হয়েছে? আমার মেয়ে ভালো আছেতো?
-- জ্বি এখন আপনার মেয়ে সুস্থ আছে। কিন্তু...
- কিন্তু কি ডক্টর, প্লীজ বলুন আমার মেয়ের কি হয়েছে?
-- আসলে আপনার মেয়ের মাথায় ব্রেন্টে টিঊমার হয়েছে। ৩ মাসের মধ্যে অপারেশন না করালে আপনার মেয়েকে বাচানো সম্ভব হবেনা। আর আপনার মেয়েকে অপারেশন করাতে কমপক্ষে ৫ লক্ষ টাকা লাগবে।
ধপ করে মেঝতে পরে গেলাম। চোখ দিয়ে পানির স্রোত বইছে। টুশির কিছু হলে আমি কি নিয়ে বাচবো।
- হে আল্লাহ আমার ভাগ্যে কি এটাও লেখা ছিলো। সবকিছু তো শেষ হয়ে গেছে, এখন আমার বেচে থাকার শেষ সম্বলটুকুও কেনো কেড়ে নিতে চান?
Tags
ছোট গল্প