প্রাক্তন বাংলা গল্প | bangla golpo
বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাচ্ছি। আসলে মেয়েটা আমার জন্যই দেখা হচ্ছে। চার বছর আগে যখন আমার প্রাক্তন আমাকে ছেড়ে অন্য কারো হাত ধরেছিল তখন বিয়ে করার ইচ্ছেটাই মরে গিয়েছিল।
তবে পরিবারের চাপে চার বছর তো বিয়ের কথা এড়িয়ে গিয়েছি তবে এখন আর পারছি না। তবে দেখতে গেলেই তো আর বিয়ে হচ্ছে না। এই বলেই স্বান্তনা দিয়ে তাদের হাসির সাথে মেতে উঠেছি।
তিন বছর আগেই পড়াশোনা শেষ করেছি। তবে চার বছর আগে যখন আমি আমার প্রাক্তন কে বিয়ে করতে চাই তখন প্রাক্তনের বাবা বড় গলায় আমাকে কথা শুনিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিল।
সেদিন রাতে ও আমাকে ফোন দেয়। ফোন কানে রেখে প্রায় ঘন্টা তিনেক আমরা কথা বলিনি। শুধু কেঁদেছি। তারপর দু'জনেই পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করি।
সে বয়সে সেটা আবেগ বা মোহ ছিল না। ছিল না কোন শারীরিক চাহিদা। শুধু ছিল ভালোবাসা। তবে সব ভালোবাসার পূর্ণতা হয় না। কিছু কিছু ভালোবাসা অপূর্ণই থেকে যায়।
পালিয়ে যাওয়ার তারিখও ঠিক। ওর কবুল বলে বিয়ে করার ঠিক ১ঘন্টা আগে আমরা এ শহর ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবো। তবে সেদিন রাত ১১টার ট্রেনের টিকিটও কেটে রেখেছিলাম।
তিস্তা এক্সপ্রেস ছিল ট্রেনটি। কোথায় নামবো তার নিশ্চয়তা ছিল না। তবে স্বপ্ন ছিল এই রাত ও ট্রেনটি নিয়ে। তবে,
ঘড়ির কাটা ১১টায় পৌঁছে যায়, তিস্তা এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্মে চলে আসে আবার সঠিক সময় প্ল্যাটফর্ম খালি করে। তবুও সে আসেনি।
এয়ারপোর্ট থেকে এই ট্রেনটিই সর্বশেষ ট্রেন ছিল সেদিনের। সকাল অবধি নির্ঘোম ভাবে কাটিয়ে দেই তবে তার দেখা মিলেনি আর। তবে ফোনে ভিডিও মেসেজ পেয়েছিলাম একটি।
যেটা পাওয়ার পর গিয়েছিলাম তার বাড়ি। তবে সেখানে কেউ ছিল না। বাড়ি বিক্রি নাকি অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে। আর তারাও নাকি শহর ছেড়ে দিয়েছে।
কিছু প্রশ্নের আর উত্তর মেলেনি সেদিন। খুঁজিওনি তাকে আর। আর স্বপ্নগুলো অপূর্ণ রয়ে যদি তার স্বপ্ন পূর্ণতা পায় তাহলে সেটাই সই।
আজও সেই তিস্তা এক্সপ্রেস। সেই আগের মতোই কালো অন্ধকার রাত। ছুপছুপ করে আপন গতিতে ট্রেন চলছে। আর তার ভেতরেই বসে আছি আমি।
নভেম্বরের শেষের দিক। হালকা শীতের আবাশও পাওয়া যায় রাতের গভীরতার সাথে। তবে বাইরে দৃশ্যটা মন জুড়িয়ে যাওয়ার মতো।
বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই একটা চাদর গায়ে দিয়ে কখন ঘুমিয়ে গেছি বলতেই পারিনা। তবে চোখ খুললো মানুষের কোলাহলে।
চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি জামালপুর স্টেশনে ট্রেনটি দাঁড়িয়ে আছে। তখন সময় সকাল ৫টা। কতক্ষণ সময়ে জন্য দাঁড়িয়েছে না জেনেই।
ট্রেন থেকে থামবো কি নামবো না বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবে যখন জামালপুরে পা রাখবো তখনই ট্রেনের হুইশেলটা বেজে উঠে উঠলো। আর পিঠে কেউ হাত রাখলো।
পিছনে ফিরে দেখি ভাবি। তাকে দেখে শুঁকনো একটা হাসি দিয়ে ট্রেনের দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। তারপর নিজের জায়গায় এসে বসলাম।
আমার সাথে ভাইয়া ঘুমাচ্ছে। ভাবি ভাইয়াকে ডেকে তুলে তার সিটে পাঠিয়ে দিল। আর এসে আমার পাশে বসলো।
ভাবির কোন ভাই নেই। বলতে গেলে তার মা ছাড়া আর কেউ নেই। ভাবি আমাকে তার ছোট ভাই ভাবে। আমার যেহেতু বোন নেই তাই ভাবিকেই বোনের থেকে বেশি ভাবি।
ভাবি আমার হাতটা ধরে বললো,
এখনো ভুলতে পারিসনি অতীত? এই ক্ষতগুলো প্রকাশ্যে না থাকলেও ভেতরে এর পরিমান কতটা বুঝতে পারছি। (ভাবি)
আমি শুকনো হাসি দিয়ে বললাম,
থাক না ভাবি। অতীত তুলেই বা কি লাভ? যতটা ভুলে থাকা যায় ততটাই মঙ্গল। (আমি)
নিজের দিকে একবার খেয়াল কর। তর মনের অবস্থা জানতে চাইবো না। তবে যে সিধান্ত নিবি সেটাতে যাতে তর খুশিটা থাকে। (ভাবি)
নিজের খুশির জন্যই তো করছি। (আমি)
নিজের মনকে প্রশ্ন করে দেখ? উত্তর টা তুই আমার থেকেও ভালো জানবি। হয়তো আমাদের খুশির জন্য তুই বিয়ে করার সিধান্ত নিলি এবং বিয়েও করে নিলি। তবে যেদিন সবার সামনে সবটা প্রকাশ পাবে সেদিন সবাই কষ্ট পাবে। শুধু সেই মেয়েটা যে তর জীবনে জড়াবে বরং আমি,বাবা,মা তর ভাইয়া সকলেই। (ভাবি)
কোন উত্তর ছিল না আমার কাছে। কারণ আমি এ সিধান্তে খুশি ছিলাম না। পরিবারের জন্যই এতদূর আসা।
দেখ তর সময় লাগলে তুই নিয়ে নে। তবুও আমাদের খুশির জন্য নিজের খুশিটা বিসর্জন দিছ না। অন্যকে খুশি রাখতে গেলে আগে নিজেকে খুশি থাকতে হবে। (ভাবি)
ভাবির কথায় লজিক আছে বলতে হবে। তবে আমি না ওকে ভুলতে পারছি না কাউকে আপন করে নিজের জীবনে জড়াতে পারছি।
হঠাৎই চলন্ত ট্রেন থেমে যায়। আর আমার ভাবনার অবসান ঘটে। জানালা দিয়ে বাইরে মাথা বের করে দেখি দেওয়ানগঞ্জ বাজার লেখা দেখা যাচ্ছে। তার মানে এটাই আমাদের গন্তব্য।
আর তার থেকেও বড় কথা ট্রেনটি আর আগে যাবে না। কারণ এটাই এই পথের শেষ। হিমেল হাওয়ায় ঠান্ডা লাগছে তবে স্টেশনে ঘুমানো মানুষদের দেখে সেটাও চলে গিয়েছে।
সময়ের অনেকটা আগেই পৌঁছে গিয়েছি। সবাই ব্যাগগুলো আমাকে দিয়ে নাস্তা করতে চলে গেল। কারণ জায়গাটা নতুন কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। তাই পরিপূর্ণ ভাবে আলো ফুটবার আগে স্টেশন ছাড়া যাবে না।
আমি বসে ফোন চাপছিলাম। তখনই একজন গর্ভবতী মহিলা এসে হাত পাতে আমার কাছে,
সাহেব আমার সন্তান পেটে। ভালো মতো কিছু খাইতে পারি না। যদি কিছু দিতেন। (মহিলাটি)
আমার নানা সবসময় একটা কথা বলতেন,"যদি তোমার কাছে কেউ হাত পাতে তাহলে তাকে ফিরিয়ে দিও না।"
উনার হাতে টাকা না থাকলেও উনি কাউকে খালি হাতে ফিরাতেন না। উনি সব সময় টাকা বাংটি করে চালের ডামে,বৈয়মের ভেতর ও নানা জায়গায় রেখে দিতেন। যখন কেউ এসে চাইতো তখন বের করে দিয়ে দিতেন।
তাহলে এখন আমিই বা একজন গর্ভবতী মহিলাকে কি করে ফিরিয়ে দেই? যখন ৫০০ টাকার নোটটি বের করে তার হাতে দিব। তখন তার দিকে তাকাতেই নোটটি পড়ে যায়। সেও আমার দিকে বিস্ময় প্রকাশ করে।
এতক্ষণ মাথা নিচে দেওয়ায় ও আবছা আলোয় চেহারা দেখতে পায়নি। তবে যখন দেখেছে সে সেখান থেকে উল্টো ঘুরে হাঁটতে থাকে।
গর্ভবতী মহিলাকে দেখে আমার হৃৎস্পন্দনের মাত্রাই বেড়ে যায়। কারণ সে ছিল ছায়া আমার প্রাক্তন। এভাবে তার সাথে দেখা হবে কল্পনা করিনি। আর তাকে এ অবস্থায় দেখবো সেটাও ভাবিনি কখনো।
সে চলে যেতে নিলে তার হাতটা ধরে তাকে আমি আঁটকে ফেলি। মনের মাঝে হাজারো প্রশ্নের ঝড় উঠেছে। এই ঝড় সহজে থামবার নয়। কি হবে এখন বা আগে?
তুমি? (আমি)
অপরদিকে ঘুরে নিঃশব্দে কাঁদে। তবে একটা কথাও বলে না।
আজও চুপ করে থাকবে? কেন আজও কিছু বলবে না? (আমি)
এইবার আমার দিকে ফিরে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আমার হাত থেকে তার হাত ছাড়িয়ে বলে,
কি বলবো? এখনো কি বলার মতো কিছু রয়েছে? আজও আমার থেকে শুনতে চাও? (ছায়া)
হ্যা শুধু আজ নয় স্বপ্নটা শেষ নিশ্বাস অবধি বলার মতো দেখেছিলাম। তবে কেন? আমার মনে যে প্রশ্নের ঝড় বইছিল সেটা তো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আজ আবারও সেই ঝড় তুলে কেন পালিয়ে যাচ্ছো? (আমি)
শান্ত গলায় আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
মাহিন তোমার প্রশ্নের জবার আমার কাছে নেই। আর কিই বা বলবো আমি? আর কেনই বা তুমি বিশ্বাস করবে? (ছায়া)
আজ তোমায় বলতেই হবে। যে সম্পর্ক পূর্ণতার জন্য তখন এত কিছু করেছিলে!! কি এমন হয়েছিল যে তা অপূর্ণই রাখতে হল? ছায়া আজ তোমায় মুখ খুলতেই হবে। (আমি)
আজও কি সেই সময় আছে? অনেকটা দেরি হয়ে গেল না প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করার জন্য? চার বছর কিন্তু কম সময় না মাহিন? (ছায়া)
চার বছর? নাহ্ ছায়া, চার বছর পাঁচ মাস সাতাশ দিন আট ঘন্টা পয়ত্রিশ মিনিট। সময়টা কি খুবই অল্প? (আমি)
দু'জনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে নিরব দর্শক হয়ে যাই। ততক্ষণে পরিবারের সকলেই আবার স্টেশনের ভেতর প্রবেশ করেছে।
ও কথা না বলে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আটকে নিয়েছি। তখনই আমার পরিবারের লোকেরা নাস্তা শেষ করে স্টেশনে ফিরে।
কিন্তু তারা যখন কাছে আসে, আসতে আসতে বিস্মিত হয়ে যায়। কারণ তারাও হয়তো ছায়াকে এভাবে এই জায়গায় আশা করেনি।
কে কি বলবে? তা খুঁজে পাচ্ছে না। এতবছর পর এই অবস্থায় দেখে তারা আমার থেকেও বেশি অবাক হয়েছে।
একটু ঝাঁঝাল কন্ঠেই কথাটা বললো আমাকে,
মাহিন ও এখানে কেন? আর তুই বা ওর হাত ধরে আছিস কেন? (মা)
হাতটা ছেড়ে দিন৷ নাহয় আপনারই সমস্যা হবে। আমি এখন শুধু রাস্তার মেয়ে। আমার কোন ঠিকানা নেই।আমি আর আগের ছায়া নেই। (ছায়া)
ওর এই কথায় ওর কষ্টটা স্পষ্ট ফুটে উঠছে তবে সবার এর অর্থটা বুঝার ক্ষমতা নেই।
আমি এখন কি করবো? কোনদিকে হাঁটবো!! বুঝে উঠতে পারতেছি না। কারণ একদিকে পরিবার আবার আরেকদিকে প্রাক্তন।
প্রশ্নগুলো ঝড় তুলে তুলপার করে ফেলতেছে। তবে কেন জানি আজ ছায়ার পাশে দাঁড়াতে খুব ইচ্ছে করছে।
তবে মায়েরও কড়া নির্দেশ যাতে করে হাতটা আমি ছেড়ে দেই। তবে যে মানুষটি সেদিন ওভাবে ছেড়ে গিয়েছিল সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। শুধু একটু সুখের জন্য? তাহলে আজ তার এ অবস্থা কি করে? বিষয়টা আমাকে খুব ভাবাচ্ছে।
ভাবনার জগতে ডুবে থাকার মাঝেই আবারও কানে ঝাঁঝালো কন্ঠে ভেসে আসলো,
তুই এখনো ওর হাত ধরে আছিস? তকে আমি কি বললাম? শুনতে পাসনি!!! (মা)
আমি এখন আর হাত ধরে রাখতে পারিনি। হাতটা ছেড়ে দিয়েছি। কেনই বা ছাড়লাম তাও অজানা আমার কাছে।
জীবনের মোড়গুলো বড়ই অদ্ভুত। যেখানে সবটা শেষ হয়েছিল আজ সেখান থেকেই আবার শুরু হতে যাচ্ছে। তবে সব যেন ঘুলিয়ে যাচ্ছে।
একটু রেগে বললো,
বেহায়া মেয়ের মতো এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা ভাগ এখান থেকে। (ভাইয়া)
আরেহ ওকে কি বলছিস? ওদের মতো মেয়েদের লজ্জা শরম আছে নাকি? যদি থাকতো তাহলে এভাবে অসহায় সেজেগুজে আবার আমার ছেলের কাছে আসতো না। (মা)
ছায়া চুপচাপ সব কথা শুনে যাচ্ছে। আমি যেন কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। জানি না কেন? আমি আজ থেমে গেলাম।
কিন্তু ছায়া ঠিকই আমাকে তার পাশে আশা করেছিল। তবে চুপ থাকতে দেখে সে নিরাশ হয়ে গেল।
মনে মনে কথাগুলো নিজেকেই বললো,
আর হয়তো তুমি আমাকে ভালোবাসো না। যদি বাসতে তাহলে অবশ্যই আমার অপমান গুলো এভাবে সহ্য করতে না। তুমি বদলে গেছো। হয়তো নিজের জীবনে এগিয়ে গেছো। বিশ্বাস কর, আমি পারিনি না বদলাতে না এগিয়ে যেতে। আজকে পরিস্থিতি আমাকে এ পর্যায়ে দাঁড় করিয়েছে। তুমি যদি সবটা জানতে তাহলে হয়তো এভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে না। (ছায়া)
তারপর চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস নিল। তবে পরক্ষণেই এক ফোঁটা চোখের জল তার গাল বেয়ে নিচে পড়লো।
রাগে একটা ধাক্কা দিয়ে,
কান্নার অভিনয় করে আবার আমার ছেলের মন গলাতে এসেছিস কাল নাগিনী। দূর হ চোখের সামনে থেকে। (মা)
ধাক্কার তাল সামলাতে না পেরে ছায়া পড়ে যেতে নিলে আমি তাকে ধরে ফেলি। তাকে ধরার ইচ্ছা ছিল না। তবে এ অবস্থায় দেখে অনিচ্ছা থাকা সত্যেও ধরে ফেলি।
আপনাকে আমাকে ধরতে হবে না। মানুষের লাথি ও ধাক্কা খেয়েই বেঁচে আছি। এগুলো এখন আর আমার কাছে নতুন নয়। আমি জানতাম আজ আপনারা এখানে আসবেন!! আর অন্ধকার থাকায় চিন্তেও পারিনি। যদি চিন্তাম তাহলে সামনে যেতাম না। আসলেই আমি অভাগী। ভালো থাকবেন আমি এখন আসি। (ছায়া)
একদমে কথাগুলো বলে সে উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করলো।
জানি না কেন? তার প্রত্যেকটা কথা আমার বুকে এসে গেঁথেছিল। পরিবারের সবাইও তার এমন কথা শুনে অবাক হয়েছে।
আমি তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কেন জানি চাইতেও তাকে ফিরিয়ে আনতে পারতেছিলাম না। শুধু অবাক নয়নে তার বদলে যাওয়ার কারণ খুজতেছিলাম।
মনে মনে নিজেই তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলাম,
জানো প্রিয়, আমি বদলে যাইনি। এখনো ভালোবাসি। আগের মতো নয় বরং তার থেকেও বেশি। তোমাকে হারানোর পর পাগল প্রায়ই ছিলাম। আজও তোমার আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কারণ খুঁজে বেড়াই। আজকে সবাই যখন তোমাকে কথা শুনাতে ব্যস্ত তখন মনের মাঝে কিছু একটার সংশয়ের জন্যই তোমার পাশে দাড়াতে পারিনি। তবে আমি বদলে যাইনি। বরং এখনো আগের থেকে অনেক বেশি ভালোবাসি। কেন সেদিন ওভাবে হারিয়েছিলে? (আমি)
কথাগুলো মনের গভীরেই রয়ে গেল। চোখ বন্ধ করতেই যেন চোখের পানি বাঁধ পেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেল। তবুও নিজেকে সামলে নিলাম।
অনেকটা সময়ই নিরবতা বজায় ছিল আমাদের সবার মাঝে। কেউ কারো সাথে তেমন কোন কথা বলতে ছিল না। এভাবেই রওনা দিলাম আত্মীয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
তবে স্টেশনেই যেন মনটা পড়ে রইলো। কেন জানি না ছায়ার পাশে থেকে সবটা জানতে ইচ্ছে করতেছে। কিন্তু অভিমানের পাল্লা এতই ভারী যে পারছি না তার পাশে দাঁড়াতে।
আধঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। তবে যাদের বাড়িতে মেয়ে দেখতে এসেছি সেই বাড়িটা সম্পূর্ণ পুরানো ডাকবাংলোর মতো। বিশাল সাইজ অদ্ভুত দেখতে।
বাড়ির দিকে তাকিয়ে ছায়ার কথাটা যেন কিছুক্ষণের জন্য মন থেকে সরে গেল। আর আমিও বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম।
এখানে আমাদের দুই রাত তিন দিন থাকতে হবে। মেয়ে দেখার জন্য নয় বরং তাদের মেহমান হিসেবে। তাদের পরিবার উচ্চবিত্ত বলে মনে হয় না। তবে তাদের ভেতরটা আপনাদের সব ধারণা বদলে দেবে।
এখন আমাদের মেয়ে দেখার পালা। অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে যখন কনে কে লাল শাড়ি পড়িয়ে আমাদের সামনে এনে বসালো তখনও মেয়েটির চেহারা দেখতে পাইনি। কারণ ঘোমটাটা একটু বড়সড়ই ছিল।
যখন সবার সম্মতিতে ঘোমটা খুললো তখন সবাই তাকিয়ে ছিল। আমিও তার সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তবে হারিয়ে গিয়েছিলাম অন্য জগতে।
তার এমন সাজ দেখে মনে পড়ে যায় ছায়ার কথা। সম্পর্ক চলাকালীন একদিন আমার জন্মদিন সে এভাবেই সেজে আমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছিল। একদম একইরকম সাজগোজ দেখে অনেকটাই অবাক হলাম।
কারণ এরকম সাজের বর্ণনা শুধু আমিই বলেছিলাম ছায়াকে। তাকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম কে সাজিয়েছে? তখন সে উত্তর দিয়েছিল তার বান্ধবী।
কিন্তু কোনদিন তার এই বান্ধবীর সাথে আমার দেখা হয়নি। শুধু নামটা শুনেছিলাম, "মরিয়ম"। অদ্ভুত তাই না?
হঠাৎই একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো আমায়। ভাবিনি সে করবে। হ্যা কনের ভেসে আসা মেয়েটিই বললো,
আপনার না এরকম সাজ পছন্দ? তাই তো এরকম সাজলাম? ভালো লাগেনি? (কনে)
আমার বিয়েতে তেমন কোন ইন্টারেস্টই নেই। তাইতো কনের নামটাও অজানা আমার কাছে। তার প্রশ্নের জবাবে আমি উল্টো প্রশ্ন করলাম। আমার প্রশ্নে পুরো পরিবেশ মহলই বদলে গেল।
শান্তভাবে তার দিকে তাকিয়ে,
আপনাকে কে সাজিয়েছে? সে কে? কি তার নাম ? (আমি)
আমার এমন প্রশ্ন যেন তাদের মাথার উপর দিয়ে গেল। আর কনে সাজে থাকা উনি তো একদম বোকা হয়ে গেল।
পিছন থেকে হাল্কা ধমক দিয়ে,
কে সাজিয়েছে সেটা বড় কথা? নাকি ওকে কেমন লাগছে সেটা বড়? (মা)
আমিও সোজাসাপটা উত্তর দিয়ে দিলাম,
বর্তমানে আমার কাছে কে সাজিয়েছে সেটাই বড় কথা। আপনি বলেন কে সাজিয়েছে আপনায়? কি তার নাম? (আমি)
আমার এমন উদ্ভট কৌতুহলী আচরণে সবাই যেন বিরক্ত হয়ে গেল। বাড়ির লোক তো ভাবতেই আছে আজ মানসম্মান হয়তো সব শেষ।
তবে সবকিছুর উর্ধে সেই মেয়েটি আমাকে আমাকে তার খোঁজ দিল যে তাকে সাজিয়েছে। তার নাম তো বলতে পারেনি বরং মেয়েটি যে ঘরে আছে সে ঘর দেখিয়ে দিল।
আমিও উঠে সেদিকে যাত্রা শুরু করলাম। কারণ মনের মাঝে হাজারো প্রশ্নের তোলপাড় চলছে। লাগছে যেন সবকিছু একটি সূত্রে গাঁথা।
পিছন বাবা মা ভাই ভাবি সবাই ডেকেছে। কিন্তু আমার সেদিকে কোন খেয়ালই ছিল না। সবকিছু তোয়াক্কা না করে সেই ঘরে নক করে যখন ঘরে প্রবেশ করলাম। ভেতরে গিয়ে আমি অনেকটাই অবাক হয়ে গেলাম।
আমিও উঠে সেদিকে যাত্রা শুরু করলাম। কারণ মনের মাঝে হাজারো প্রশ্নের তোলপাড় চলছে। লাগছে যেন সবকিছু একটি সূত্রে গাঁথা।
কারণ ভেতরে এমন কিছু দেখতে হবে তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। কারণ যে মানুষটার চেহারা আমি কল্পনায় এঁকেছি আর যাকে সামনে দেখছি দু'টোর মাঝে আকাশ পাতাল তফাত।
ঘরের ভেতর বারো কিংবা তেরো বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। মেয়েটি এটা ওটা আঁকাআকি করতেছিল। তবে আমায় দেখে থেমে গেল।
আমাকে দেখে মেয়েটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
আপনি? এই ঘরে? ভুলে চলে এসেছেন? (মেয়েটি)
আমায় দেখে একটু ইতস্তত হলো না। বরং শান্ত ভাবেই বললো। এমন ভাবে কথাটা বললো যেন আমি তার পরিচিত কেউ।
আমিও নিজেকে শান্ত করে জবাবে বললাম,
তুমি কি আমায় চিনো? আমাকে এভাবে দেখে ভয় বা বিরক্তির ছাপ কেন নেই তোমার চেহারায়? (আমি)
হ্যা চিনি তো। আপনি তো লিলু আন্টিকে দেখতে এসেছেন। তা ছাড়া চেহারা নিয়ে কিসব বলছেন? বুঝতে পারতেছি না। (মেয়েটি)
তার মানে যাকে দেখতে এসেছি তার নাম লিলু। কিন্তু এখন তো এসব জানার বা বুঝার সময় নেই। তাই তাকে প্রশ্ন করলাম,
তোমার নামটাই বা কি? তোমার আন্টিকে কে সাজিয়েছে? (আমি)
আমার নাম নিপা। আমিই তো সাজিয়েছি আন্টিকে। কেন দেখতে খারাপ হয়েছে নাকি? নালিশ করতে এসেছেন? (নিপা)
কিহহ!! তুমি? এরকম করে সাজানো তোমায় কে শিখিয়েছে? আর আমার লাগবে সেটা কি করে জানলে? (আমি)
আমি আমার আম্মুর থেকে শিখেছিলাম যখন ছোট ছিলাম। তবে আপনার ভালো লাগবে সেটা শুধু আন্দাজ করেই বলেছিলাম। (নিপা)
তোমার আম্মুকে একটু ডাকো। তোমার আম্মুর সাথে কথা বলতে চাই। (আমি)
এ কথাটি বলার পর নিপা একটু চুপচাপ হয়ে গেল। মন খারাপ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
আমার আম্মু মারা গেছে যখন আমার ৭ বছর বয়স। (নিপা)
আমি দুঃখিত। আমি আসলে জানতাম না। মন খারাপ কর না। তোমার আম্মু তোমার পাশেই আছে। সেই দূর থেকে তোমার উপর নজর রাখছে। (আমি)
ধমকের সুরে পিছন থেকে বললো,
মাহিন তুই কি শুরু করেছিস বল তো? মানসম্মান কি কিছুই রাখবি না? কে না কে সাজিয়েছে তা দেখার জন্য এরকম একটা মহল থেকে সব ছেড়ে ছুটে চলে এলি। চল এখন আমার সাথে। (মা)
কিছুই বলতে পারলাম না। কারণ এখানে তো আমি এসেছি লিলুকে দেখতে। পছন্দ হলে হয়তো তার সাথে বিয়েও দিয়ে দিবে।
মায়ের একগাদা বকা শুনে তার পিছন পিছন হেঁটে আবারও সেই আগের অবস্থানে চলে আসলাম। তবে নিপার সাথে আমার কথা যেন অসমাপ্ত রয়ে গেছে।
আবার কথাবার্তা চলতে থাকে। এক পর্যায়ে তাদের কথাবার্তা শেষ হলে আমাদের দু'জন কে একটি ঘরে আলাদা ভাবে কথা বলতে পাঠায়।
তবে লিলুর মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে আমায় বিয়ে করতে রাজি। যদি এখনি করতে বলে তাহলে এখনি করে নিবে। বিষয়টা কেন জানি না সুবিধার টিকছে না।
আমরা দু'জন সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আছি। মিনিট পাঁচেক হয়ে গেছে কেউ কথা বলছি না। সে হয়তো মেয়ে হয়ে আগে কিভাবে বলবে সেটা ভেবে চুপচাপ আছে। তবে আমি তো অতীত ভেবে নিরব হয়ে আছি।
নিরবতা ভেঙে আমিই বললাম,
আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি? যদি কিছু মনে না করেন তো!! (আমি)
হুম করেন। তবে কেন জানি মনে হচ্ছে প্রশ্নটা আমাদের সম্পর্কের বাইরে হবে। (লিলু)
হতে পারে!!! (আমি)
সমস্যা নাই বলেন। (লিলু)
আচ্ছা নিপা মেয়েটি কে? কি হয় আপনাদের? (আমি)
মুচকি হেসে জবাব দিল,
বলেছিলাম সম্পর্কের বাইরের প্রশ্নটাই করবেন। আর সেটাই হলো তো। তাহলে শুনুন, নিপার মা নেই। সাতবছর আগেই মারা গেছে। নিপা থাকে তার নানার সাথে। এখানে এসেছে তার খালাকে খুঁজতে। তার নানা নিপা নিয়ে কত জায়গায় খুঁজবে। তাই আমাদের মেহমান হয়ে আছে। আর নিপা সারাদিন আমার সাথেই থাকে। এতে দু'জনের সময়টাই কেটে যায়। (লিলু)
ওহহ আচ্ছা। চলুন অনেকটা সময় পার হয়ে গিয়েছে। (আমি)
আমাদের ব্যাপারে কথা না বলেই চলে যাবেন? (লিলু)
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলাম,
আপনাদের বাসায় তো আরো কিছুদিন রয়েছি। এখানে এমনিতেই একটু সময় লেগে গেছে। দেরি হলে তারা নানান কথা ভাববে। আমাদের সময়টা নাহয় পরের জন্য উঠিয়ে রাখলাম। (আমি)
মাথা নিচু করে শুধু আচ্ছা বললো। তারপর চলে আসলাম আবারও সেই বিরক্তিকর মহলে।
দেখাদেখির সভা শেষ হওয়ার পর গ্রাম ঘুরে দেখার উছিলায় বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য আমার দেওয়ানগঞ্জ বাজার স্টেশন। মিথ্যে বলার কারণটা খুঁজে পেলাম না।
স্টেশনে পৌঁছে এদিক ওদিক তাকালাম। আবারও সেই করুন দৃশ্য। সবে মাত্র ময়মনসিংহ থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি থেমেছে। লোকজন নামতে ব্যস্ত। আর অন্যদিকে ছায়া প্রত্যেকের কাছে হাত ফেলাতে ব্যস্ত।
কেন জানি নিজেকে সামলিয়ে রাখা কষ্টকর হচ্ছিলো। তবুও এক কদম এগিয়ে কিছু একটা মনে করে তিন কদম পিছিয়ে গেলাম।
দূর থেকেই ছায়ার বিভিন্ন লোকের কাছে সামান্য খাবারের জন্য হাত পাতা দেখতেছিলাম। আমি কেন কিছু করতে পারছি না? কেন তার চোখের জল আমার সহ্য হচ্ছে?
মনের কোণায় কতটুকু পরিমাণ অভিমান জমলে একটা মানুষ আমার মত পাষাণ হতে পারে। হঠাৎই দেখলাম একটি হোটেলের পিচ্চি ছেলে। ছেলেটি সেখানে টেবিল মোছা ও গ্লাস ধুয়ার কাজ করে হয়তো!!
ছেলেটি এসে ছায়াকে সামান্য কিছু খাবার দিল। আর ছায়া সেটা মনের আনন্দে গ্রহন করলো। অদ্ভুত নিষ্ঠুর পৃথিবী বাইরে থেকে যতটা সুন্দর তা ভেতর থেকে ততটাই অসুন্দর।
স্টেশনে এত মানুষ কিন্তু কেউ কারো দিকে তাকিয়ে দেখার একটু সুযোগ নেই। যে যার যার মতো করে এগিয়ে যাচ্ছে।
যাই হউক আমি যে ছায়ার দিকে তাকিয়ে ছিলাম সেটা একজন বৃদ্ধ চাচা ঠিকই খেয়াল করেছে। যখন তার দোকানের সামনে গিয়ে বসলাম তখন তার দোকান ফাঁকাই ছিল।
চাচা আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
কি বাবা অনেকক্ষণ যাবত দেখতেছি তুমি ঐ মেয়েটির দিকে নজর রাখছো? কি চাও বলো তো? (চাচা)
চাচা আমি শুধু এটাই জানতে চাই, যে মানুষটা এত সুখ শান্তিতে ছিল তার এমন পরিণতি কেন? আর সে এই স্টেশনেই বা কত দিন? (আমি)
এত কিছু জেনে তুমি কি করবে বাবা? মেয়েটির সাথে বাজে কিছু করার চিন্তাভাবনা নাকি? (চাচা)
চাচা যদি এতই নিষ্ঠুর মন হতো না আমার? তাহলে সেটা অনেক আগেই করে ফেলতাম। ওকে আমি আরো নয় বছর আগে থেকে চিনি। (আমি)
তাহলে সামনে যাও!!! কথা বলো ওর সাথে? এমন অবস্থায় ওর তো কেউ প্রয়োজন। (চাচা)
চাচা একটি ঝড়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন একটি মানুষ। এত সহজেই কি সবটা বলবে? আমাকেই সবটা খুঁজে বের করতে হবে। প্লিজ জানলে বলেন না? (আমি)
তোমার কথায় কেন জানি হৃদয় পুড়া অনুভূতি আসছে। তাই বলা যায় তোমায়। মেয়েটি অতীত সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। কিন্তু সাত মাস আগেই মেয়েটি এখানে আসে। মেয়েটির অবস্থা খুবই করুন ছিল। দেখে মনে হয়েছে খুব নির্যাতন চলেছে ওর উপর। ওকে জিজ্ঞেস ও করেছিলাম। শুধু বলেছে," টাকা দিয়ে সুখী করতে চেয়েছিল বাবা। হ্যা সুখী আছি অনেক। আমার মতো সুখী আর কেউ নেই।" যতজনই ওকে ওর অতীত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছে ও শুধু এ কথাই বলেছে। আর এই স্টেশনে তারপর থেকেই ওকে সবাই পাগল বলে। (চাচা)
আমি চাচার সাথে আর কথা বাড়াই না। উঠে হাঁটতে থাকি। পিছন থেকে উনি অনেক ডেকেছিল তবে আমি আমার মধ্যেই ছিলাম না।
সারাদিন জনমানবহীন একটা জায়গায় বসে কাটিয়ে দেই। বসে বসে আমি কি ভেবেছি সেটা আমার কাছেও অজানা।
তবে রাতে সেই বাড়িতে ফিরি। এত রাতে ফেরাট কারণে শুরু হয় তাদের বকাবকি। তবে সেসবে কান না দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যাই।
ফ্রেশ হয়ে সবাই একসাথে খেতে বসি। সারাদিন জনমানবহীন একটা জায়গায় বসে কাটিয়ে দেই। বসে বসে আমি কি ভেবেছি সেটা আমার কাছেও অজানা।
ফ্রেশ হয়ে সবাই একসাথে খেতে বসি।
খাওয়ার পর সবাই একসাথে বসে গল্প করতেছিল। তবে আমি শুধু নিপা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। জানি না কেন? কিন্তু অদ্ভুত এক মায়া রয়েছে মেয়েটির চেহারায়।
সবাই যার যার ঘরে ফিরবো তখনই কেউ একজন বাড়িতে আসলো। রাততো অনেক হয়েছে? এত রাতে আবার কে?
সেখানে উপস্থিত আমি বাদে সবাই এমন ভাবে বসে গল্প করছে যেন এটা রোজকার মতন। শুধু আমিই অবাক হয়ে চেয়ে আছি শুধু দেখার জন্য কে এসেছে?
দরজা দিয়ে যে মানুষটা ভেতরে প্রবেশ করলো তাকে দেখে বিস্ময় না হয়ে পারলাম না। সাথে সাথে দাঁড়িয়েও গেলাম।
ছায়ার বাবা!!! ভুল দেখছি না তো আমি? বার বার চোখ ডলে বিষয়টা বুঝার চেষ্টা করতে ছিলাম। কিন্তু পরিবেশটা এত শান্তই বা কি করে? কোন প্রকার ঝড় আসার কি পূর্ব লক্ষণ এটা?
আমি যতটা না অবাক হয়েছি তার থেকেও বেশি ছায়ার বাবা অবাক হয়েছে। সেও বিশ্বাস করতে পারতেছে না। যে আসলে আমিই বা এখানে কেন?
আমাদের একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকার মাঝে নিপা মেয়েটা নানাভাই নানাভাই বলে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো।
বিষয়টা যেন আরো জটিল হয়ে পড়লো। আমার জানামতে ছায়ার তো আর বোন নেই তাহলে এ কে? এর সাথে তার কিসের সম্পর্ক? যেই না ঝটগুলো খুলতেছিল তখনি আরেকটা ঝড় এসে সেটাকে আরো জটিল করে দিল।
তাদের নানা নাতিনের কথোপকথন শুনার এখন বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হচ্ছিলো না। বরং রাগ হচ্ছিলো। তাই তো সেখান থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে গেলাম।
এই সেই মানুষ যার জন্য ছায়া আমার সাথে নেই। বরং ছায়ার বর্তমান অবস্থার জন্য এই মানুষটাই দায়ী। তবে সে এখানে কেন? আর যদি সে এখানে তাহলে কেন সে ছায়া ঐ অবস্থায় ফেলে রেখেছে?
প্রশ্নগুলোর উত্তর যেন পেয়েও হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু তখনই মনে পড়লো লিলুর বলা নিপার নানাভাইয়ের সম্পর্কের কথাটা। সে যদি ছায়াকে খুঁজছেই তাহলে পাচ্ছে না কেন?
আজ খুব করেই সিগারেট টানতে ইচ্ছে হচ্ছে। সে চলে যাওয়ার পরেও কখনো ছুঁয়ে দেখিনি। আগে থেকেই খেতাম না। কিন্তু সে সম্পর্কে থাকা অবস্থায় বার বার বলেছে সিগারেট যেন না ছুঁই। যত কিছু হয়ে যাক।
কিন্তু আজ তো না খেলে আমার শান্তি হবে না। এত টেনশন আর পেচ সব যেন মাথা গুলিয়ে দিচ্ছে। তাই ছাঁদ থেকে নেমে বাড়ির বাইরেই এক টং দোকানে চলে গেলাম।
জীবনের প্রথম সিগারেট খেয়ে দেখবো আসলেই কি মানসিক শান্তি আসে নাকি? আজ যে আমার মানসিক শান্তির খুব দরকার।
টং দোকানের চাচার কাছে যে না হাত বাড়িয়ে সিগারেট চেয়েছি তখন সাথে সাথে আরো একজন ব্যক্তি হাত বাড়িয়ে সিগারেট চায়।
অলৌকিক না লৌকিক জানা নেই তবে সেটা ছায়ার বাবাই ছিল। তবে আমার জানামতে ছায়ার বাবা কখনোই সিগারেট খায় না? আর যদিও খায় এত রাতে এভাবে বাইরে।
তাকে দেখেও কোন প্রকার কথা তার সাথে বলিনি। কেনি বা বলবো? কোন কারণ খুঁজে পাইনি!!!
সিগারেটে টান দেওয়ার সময় যখন কাশতে ছিলাম তখন ছায়ার বাবা নিজে থেকেই বলে,
আজ প্রথমবার তাই? আমিও বছরখানেক আগে এমন টেনশনে পড়ি তারপর থেকেই শুরি করি। (ছায়ার বাবা)
জবাবে কি বলবো? জানা নেই আমার। তাই তার দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে আবার সিগারেট টানতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
তুমি অনেক কিছু থেকে অজানা? তুমি যা ভাবছো তেমন কিছুই তোমার সাথে অলৌকিক ভাবে ঘটেনি। বরং সম্পূর্ণ লৌকিক ভাবে ঘটানো হয়েছে। (ছায়ার বাবা)
এইবার যেন আর চুপ করে থাকা হলো না। সবকিছুর উর্ধে বলেই দিলাম,
মানে? (আমি)
আমাকে দেখে তোমার সেদিনের কথা মনে পড়ে গেল তাই না? যেদিন তুমি ছায়ার হাত ধরে আমার সামনে এসে দুজনের ভালোবাসার কথা প্রকাশ করেছিলে। একদম কনফিডেন্সে,চোখে মুখে ভয়ের কোন চিহ্ন মাত্রও ছিল না। কিন্তু ভাগ্যক্রমে সেদিনই আমি তোমায় রিজেক্ট করে দিয়েছিলাম। মনে আছে? (ছায়ার বাবা)
লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
সেটা কি ভুলার মত? যে এত সহজে ভুলে যাব!!! সেদিন যদি আপনি হ্যা করতেন তাহলে আজ হয়তো এরকম কিছুই হতো না। (আমি)
ছায়ার বাবা একটু হাসে। তবে তার হাসির কারণ খুঁজে পেলাম না।
তোমার মনে আছে কিনা জানি না? তবে তোমাকে আমার সাথে কথা বলতে বলার আগে ছায়া একদিন তোমার সাথে যোগাযোগ করেনি।তুমি বারবার ফোন দিয়েছো সে রিজেক্ট করেছে। এক পর্যায়ে সে ফোন বন্ধ করে রাখে? মনে পড়ে? (ছায়ার বাবা)
অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলি,
আপনি কি করে জানলেন? (আমি)
তুমি বোকা ছিলে জানতাম। তবে এতটা বোকা বুঝতে পারিনি। (ছায়ার বাবা)
একটু রেগে-
কি বলতে চাচ্ছেন? (আমি)
সেদিন ছায়া তার বর্তমান স্বামী কে দেখা করাতে নিয়ে এসেছিলো। আর তোমার ব্যাপারে সবটা বলেছিল। (ছায়ার বাবা)
কিহহহ!!!! ছায়ার স্বামীকে না আপনি পছন্দ করে বিয়ে ঠিক করেছেন? তাও আমাকে পছন্দ না বলে? (আমি)
এইসব তোমাকে কে বলেছে? (ছায়ার বাবা)
ছায়া ছাড়া বলার মতো কি কেউ আছে? ( আমি)
সবকিছু ছায়ারই পরিকল্পনা ছিল। ছায়ার সাথে তার পছন্দের ও ভালোবাসার মানুষটিকেই বিয়ে দিয়েছি। (ছায়ার বাবা)
আপনি মিথ্যে বলছেন? ছায়ার ভালোবাসা তো আমি!!! যদি দিতেনই তাহলে সেদিন তো আমাক রিজেক্ট করতেন না। (আমি)
ছায়ার বাবা এখন একটু জোরেই হাসতে থাকে। আর দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট নেয়। একটা সে ধরায় আরেকটা আমার দিকে এগিয়ে দেয়।
ধর!! এটাতে আগুন লাগিয়ে টান দেও। তোমার মাথা ক্লিয়ার হবে। (ছায়ার বাবা)
আমিও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেটা নিয়ে নেই। আর ছায়ার বাবার হাসির কারণ খুঁজতে থাকি সিগারেটের ধোঁয়ার মাঝে।
বিস্মিত হইও না। ছায়া বুঝতে পেরেছিল তুমি শুধু ওর আবেগ ছিলে। ভালোবাসাটা রাব্বি ছিল। আর এই রাব্বিই ওর স্বামী। তাইতো তোমার কাছে ভালো সেজে তোমাকেই ব্যবহার করেছে। (ছায়ার বাবা)
কিন্তু? (আমি)
শুন যেদিন তুমি ওকে ফোন এ পাও নি সেদিন ও ফোন বাড়িতে রেখে রাব্বির সাথে ছিল সারাদিন। আমার সাথে মাত্র মিনিট দশেকের মতো কথা বলে চলে গিয়েছিলো। তারপর তোমার ব্যাপারে সবটা বলে। আমি জানার পর তোমাকে সব সত্যিটা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওর মনে কি চলতেছিলো আমার জানা ছিলো না। তাই আর বলা হয়ে উঠেনি। কিন্তু ও সেদিন বলেছিলো ২দিন পর ওকে বিয়ে করবে সেইটা বলতে তুমি আসবে। আর তোমাকে যাতে আমি রিজেক্ট করে দেই। আর আমিও তাই করি। (ছায়ার বাবা)
আমি যেন কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারতেছিলাম না। সবকিছুই যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিলো। হাতের মাঝে সিগারেট টা কখন পুড়ে গেছে জানতেই পারিনি।
কিন্তু যখন বুঝতে পেরেছি ততক্ষণে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। হাতের মাঝে আগুনের ফুলকির ছ্যাকা লেগে গিয়েছে।
কিন্তু ওর এত কিছু করার কি প্রয়োজন ছিল? একবার বলেই দেখতো!! থাকতে চায় না আমার কাছে। আমি কি ওকে কখনো জোর করে আটকে রাখতে চেয়েছি? (আমি)
সেটা ওর কাছ থেকেই জেনে নিও। তবে যেদিন তোমাদের পালানোর কথা সেদিন ও সেই একই ট্রেনে রাব্বির সাথে চলে আসে তোমার সামনে দিয়ে। তোমাকে স্টেশনে বসে থাকতেও দেখেছে। (ছায়ার বাবা)
আমি এতটুকু শুনে উঠে দাড়ালাম। কেন জানি আজ খুব কান্না পাচ্ছে। ও চলে যাওয়ার পরেও এত কান্না আসেনি। বরং আজ এগুলো শুনে বুকের ভেতরটা ফেটে চিৎকারের আওয়াজ বের হচ্ছে।
তবুও ছায়ার বাবার সামনে নিজেকে সামলে নিয়ে বলি,
আমি তো ওকে বার বার বলেছি কখনো চলে যেতে চাইলে ইশারা কইরো। আমিই তোমাকে তোমার গন্তব্য পর্যন্ত পৌঁছে দিব। তাহলে এত অভিনয় করার কি প্রয়োজন পড়েছিলো? (আমি)
ছায়ার বাবা কিছু বলবে তার আগেই অন্ধকার থেকে হাতে তালি দিতে দিতে কেউ একজন বের হচ্ছে। সে আর কেউ নয় বরং লিলু।
আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
বাহ্ বাহ্!! আমার জন্য এমন এক হাঁদারাম কে নিয়ে এসেছে যে কি না আগে আরেকজনের সাথে সম্পর্ক করেছিলো? আগে জানলে কখনোই রাজি হতাম না। (লিলু)
কথাগুলো সে যে বিয়ে ভাঙার জন্যই বলেছে তা তার চেহারায় স্পষ্ট।
ছায়ার বাবা লিলুকে বুঝানোর চেষ্টা করছে। তবে সে উচ্চস্বরে সবাইকে ডাকাডাকি শুরু করে। আমিই ছায়ার বাবাকে ইশারা করে কিছু বলতে মানা করে দেই।
মধ্যরাতে সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে আছি। আগে কি হবে? বা পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে তা সবার অজানা। ছায়ার বাবা লিলুকে বুঝানোর চেষ্টা করছে। তবে সে উচ্চস্বরে সবাইকে ডাকাডাকি শুরু করে। আমিই ছায়ার বাবাকে ইশারা করে কিছু বলতে মানা করে দেই।
লিলু সবাইকে ডেকে জড় করেছে। কি করতে চাচ্ছে? সেটা আর আমার কাছে ঘোলাটে নয়। তবে সেখানে থাকা বাকি সদস্যজন একটা ঘোরের মাঝে রয়েছে।
সবাইকে এভাবে এত রাতে ডেকে তুলাতে তারাও কিছুটা হলে বিভ্রান্ত হয়েছে। তবে লিলুর সেদিকে কোনরকম ভ্রুক্ষেপ নেই। সে কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে বলতে শুরু করলো,
তোমরা এই ছেলেকে আমার জন্য ঠিক করেছো? এই ছেলে তো আগেই একটি মেয়ের সাথে সম্পর্ক করেছে। না জানি কত কি করেছে? আর আমি তো বলেছি অতীতে এমন কেউ আছে কোন ছেলের। তাহলে আমি তাকে বিয়ে করবো না। (লিলু)
লিলুর পরিবার ও আমার পরিবার সবাই চুপ করে রয়েছে। কারণটা অজানা আমার কাছে। কারণ খুঁজতে যখন ভাবনার সাগরে ডুব দিলাম। তখনই লিলুর মা আমাকে বললো,
কি দরকার ছিল বাবা? তোমার অতীত সম্পর্কে ওকে বলার? (লিলুর মা)
কি সব বলছেন আন্টি? অতীত সম্পর্কে জানার অবশ্যই তার প্রয়োজন আছে। (আমি)
মাঝখানে মা ধমক দিয়ে উঠলো,
অনেক হয়েছে থাম তো। ভবিষ্যৎ ঘরতে যাচ্ছিছ সেখানে অতীতকে টেনে এনে সুখটাকে নষ্ট করার প্রয়োজন আছে কি? (মা)
এতক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম নিশ্চয়ই এ নিয়ে তাদের আগেই কথাবার্তা হয়েছে। আমাকে জানাতে শুধু ভুলে গেছে।
এমনিতেও বিয়ে করার ইচ্ছে আমার নেই। তবে সুযোগটা যখন পেয়েছি তখন কেনই বা হাতছাড়া করবো। তাই এই সুযোগটাকেই কাজে লাগালাম।
কি বলছো কি? আচ্ছা ধরো তোমাদের কথা মেনে নিলাম। কিন্তু ওর সাথে বিয়ে হলে সারাজীবন তো আমার সাথে থাকতে হবে। তখন যদি বিষয়রা জেনে গিয়ে এমন রিয়েক্ট করতো আর সেটা অনেক বড় রুপ ধারণ করতো তখন কি করতে? (আমি)
মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে তারপর তারা সবটা মানিয়ে নিতে শিখে যায়। (লিলু মা)
তার মানে এই যে সারাটা জীবন সে চুপ করে থাকবে আর আমি আমার সিধান্ত গুলো ওর উপর চাপাতে থাকবো? (আমি)
সেটা কেন হতে যাবে? ও কি এতটাই বোকা? (মা)
ওহহ মা তুমি এই কথা বলছো? একটা প্রবাদ তো জানোই, " যার হয় না নয়ে,তার হয় না নব্বইয়ে।" আশা করি ভেঙে এর অর্থটা বুঝাতে হবে না। (আমি)
বাহ্!! খুব ভালোই বলতে পারেন। আমি এই বিয়ে করবো না। (লিলু)
আমিও আপনাকে বিয়ে করার জন্য লাফালাফি করছি না। সবাই শুনে রাখো যে অতীত কে নিয়ে এত বড় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে সে আর যাই হউক আমার বউ হবার যোগ্যতা রাখে না। (আমি)
এই বলে সেখান থেকে চলে আসলাম। লিলুও চলে গেল। মাঝ খানে পরিবারের সবাই একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। তারা পিছন থেকে ডেকেছে তবে এখন উত্তর নিলে তো চলবে না।
তারপর ঘুমিয়ে যাই। চোখ খুলি সকালে কারো হাতে স্পর্শে। তাকিয়ে দেখি নিপা মেয়েটা।
আঙ্কেল আপনাকে নিচে খেতে ডাকছে। অনেক বেলা হয়ে গেছে ফ্রেশ হয়ে নিচে আসেন। (নিপা)
বলেই সে চলে যায়। তার যাওয়ার দিকে তাকাতেই মনে পড়ে যায় ছায়ার বাবা কথা। সম্পূর্ণ কথাটা তার থেকে শুনাই হয়নি।
তাই ফ্রেশ নাস্তা না করেই বেরিয়ে যাই। ছায়ার বাবাকে টেবিলে দেখতে পেলাম না। বাড়ির বাইরে বের হয়ে টং দোকানে গিয়ে সিগারেট ধরাই। একটা টান দিয়ে যখন এক পা সামনে দেই তখনই দেখি ছায়ার বাবা উদাস মনে ধোঁয়া উড়াচ্ছে।
আমিও সেখানে যাই। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে সে কিছু বলে না। একবার আঁড়চোখে তাকিয়ে আবারও ধোঁয়া উড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
আমাদের মাঝে নিরবতায় কেটে যায় অনেকটা সময়। তারপর ছায়ার বাবাই বলতে শুরু করে,
অসমাপ্ত গল্পের সমাপ্তি জানতে চাও? (ছায়ার বাবা)
মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক সম্মতি দেই।
তোমার মনে হয়তো প্রশ্ন জাগছে ছায়ার তো বোন নেই। তাহলে নিপা কে? আর যদিও বোন থাকতো তাহলে মিথ্যে কেন বলবে? (ছায়ার বাবা)
হুম (আমি)
নিপা ছায়ার বড় বোনের মেয়ে। হ্যা অস্তিত্ব ছিল তবে মুছে দেওয়া হয়েছে মায়ার অস্তিত্ব। কারণ সে ছিল ধর্ষিতা। (ছায়ার বাবা)
কথাটা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। অবাক দৃষ্টিতে অপলকভাবে তাকিয়ে রইলার তা দিকে।
হ্যা ঠিকই শুনতে পেয়েছো। ছায়ার বড় বোন মায়া। ওদের বয়সের পার্থক্য চার বছরের। বড় মেয়ে হিসেবে আদরটা একটু কম পাওনা থাকা উচিত ছিল হয়তো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়েছিল। মায়াই আদর ও স্নেহ বেশি পেত। এর মানে এই নয় যে ছায়াকে ভালোবাসতাম না। (ছায়ার বাবা)
তারপর!!! আমার ঘটনার সাথে এ ঘটনার সূত্রপাত কোথায়? (আমি)
তারপর যখন ছায়া ক্লাস টেনে উঠলো ঠিক তখন থেকেই ঝড় চলতে থাকে। মায়াকে যে ধর্ষন করে সে ছায়ার খুব প্রিয় মানুষ। তবে অদ্ভুত বিষয় ছিল এটাই ছায়ার সামনেই হয়। ছায়া হয়তো বুঝে উঠতে পারেনি যে মায়া সবটা দেখে নিয়েছে। (ছায়ার বাবা)
কিহহ!!! (আমি)
হ্যা। তবে যে ছেলে ধর্ষণ করে সে আর কেউ নয় বরং রাব্বি। অবাক হইয়ো না। নিপা রাব্বির সন্তান নয়। মায়ার বিয়ে হয়েছিলো। সুখেই চলতেছিলো। মায়ার স্বামী সবটা জেনেও মায়াকে খুব ভালোবাসতো। তবে নিপার জন্মের সাত বছর পর এক এক্সিডেন্টে দু'জনই মারা যায়। (ছায়ার বাবা)
কিন্তু ছায়া এত সব কেন করলো? মায়া বা ছায়া এদের মধ্যে কাউকে কি পালক হিসেবে এনেছিলেন নাকি? (আমি)
কথাগুলো তোমার কাছে গল্প মনে হচ্ছে? তবে ছায়ার এমন হয়ে উঠার পিছনে কিছুটা আমাদের ও দোষ রয়েছে। আমরাই ওদের দু'জনের মধ্যে মেধার পার্থক্য বের করতে গিয়ে ছায়াকেই দূরে ঠেলে দেই। যা অজান্তেই হয়ে যায়। আর ছায়াও এরকমভাবেই বেড়ে উঠে। (ছায়ার বাবা)
তবে আমার কাছে এখনো অজানা রয়ে গেল কেনই বা সে আমার সাথে এমনটা করলো? (আমি)
সে শুরু থেকেই এমন একজনকে খুঁজতেছিলো যে তার মত হবে একদম। কিন্তু সেরকমকে খুঁজতে গিয়ে সে তোমার প্রেমে পড়ে যায়। তোমার প্রেমে থাকা অবস্থায় তার মধ্যে কিছু পরিবর্তন আনে। কিন্তু তোমাদের ঝগড়ায় বিষয়টা বিগড়ে যায়। (ছায়ার বাবা)
কিভাবে? (আমি)
ছায়া ও রাব্বি একে অপরকে ভালোবাসতো না। বরং তাদের কথা বার্তা ও চেহারায় আকৃষ্ট ছিল। যা শুরু থেকে ছিল না। বরং তোমাদের সম্পর্কে যখন একটা বড় ঝড় যায় আর দুদিন কথা ছাড়া ছিলে তখনই আবারও রাব্বি ফিরে আসে ছায়ার জীবনে। (ছায়ার বাবা)
আবারও ছায়ার বাবা বলতে শুরু করে,
তুমি যখন কক্সবাজার ঘুরতে গেলে পরিবারের সাথে। ১৫ দিনের দূরত্বে আজ তোমরা কত দূরে দেখছো? ১৫ দিন তোমাদের কম কথা হয়েছে। কিন্তু রাব্বি ও ছায়া একে অপরের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তোমাদের দূরত্ব ব্যস্ততা যতই বেড়েছে ততই সম্পর্কের জাল ছিঁড়তে শুরু করেছে। আর তাইতো চার মাসের নতুনত্বের কাছে তোমার চার বছরের ভালোবাসা হেরে যায়। (ছায়ার বাবা)
কথাগুলো শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। তবে এখনও চাইলে হইতো সব ঠিক করা যাবে। কিন্তু ফেলে আসা চারটা বছর কি পাওয়া যাবে?
মরিয়ম চরিত্রের কথা মনে আছে? মরিয়মই ছায়ার ছদ্মনাম। যা প্রয়োজনে একটা চরিত্রও ধারণ করে। বেশি ভেবোনা কারণ তোমার সকল প্রশ্নের উত্তর তার কাছেই রয়েছে। তুমি বুদ্ধিমান এতক্ষণে তোমার সবটা বুঝে যাওয়া উচিত!!! (ছায়ার বাবা)
এতগুলো চরিত্র!!! তবে তার বোনের সাথে যা করেছে তার কি ক্ষমা আছে? শুধু ঘৃণার জন্য এতবড় পথ বেছে নিয়েছে?
তবে আপনি এত কিছু কি করেই বা জানলেন? আজই বা কেন বলতেছেন? সেদিন কেন বললেন না? (আমি)
আমি জানতাম তুমি এই প্রশ্ন আমায় করবে। (ছায়ার বাবা)
হুম বলেন!! (আমি)
জানো মানুষ যতই ভালো হউক না কেন? নিজের দোষটা সবসময় লুকিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রে ছায়াও একই কাজ করেছে। তেমার সাথে সম্পর্ক যদি সত্যিটা বলে নষ্ট করতো তাহলে সবার চোখে ছায়া খারাপ হয়ে যেত। তাই সে আমাকে খারাপ বানিয়ে ভালো সেজেছে। আর রইলো এত কিছু কিভাবে জানলাম? এই দুটো ডায়রি ছায়া ও মায়ার। এখানেই লেখা আছে অতীত। (ছায়ার বাবা)
ব্যাগ থেকে ডায়েরি দুটো বের করে আমায় দেয়। আমি জানতাম ছায়া ডায়েরি লিখে। কিন্তু কখনো পড়া হয়নি।
আমি ডায়েরি দুটো নিয়ে যাই। ছায়ার বাবার কাছ থেকে যখন বিদায় নিয়ে চলে আসবো তখন তিনি আমায় বললেন,
স্টেশনে থাকা অসহায় ছায়ার প্রতি তোমার একটুও মায়া হয় না? ভালো না বাসতে!! তাহলে কেন দূর থেকেই নজর রেখে চলে আসো? একটু যেয়ে কথা বলো। হতে পারে আমাকে না বলতে পারা কথা গুলো তোমায় বলবে। (ছায়ার বাবা)
আমি তার কথায় অবাক হই না। কারণ আমি ছায়াকে স্টেশনে দেখার সময়ই ছায়ার বাবাকে আসেপাশে দেখেছি।
আমি মুচকি হেসে বললাম,
হৃদয় তো অনেক আগেই ভেঙে গিয়েছে। এখন সময় পাহাড় সমান অভিমানকে চাপা দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। (আমি)
সেও আমার দিকে তাকিয়ে হাসে।
তারপর আমি চলে আসি। তবে আসার সময় পার্কের দিকে নজর যায়। পার্কে লিলু একটি ছেলের সাথে খুব কাছাকাছি ভাবে বসে আছে।
Tags
কষ্টের গল্প